কোলাহলের ভেতরেও টানে যে সুর

মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বেহালার সুর শোনা যায় মেলার প্রবেশ মুখে
ছবি: প্রথম আলো।

অনেক বড় আয়োজনের আশপাশে কিছু খুচরো আয়োজন থাকে। এর জন্য শামিয়ানা টাঙানো বা আসন পাতার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনটা যাঁর, তিনি নিজে এসেই শামিল হন। এসব মানুষ আসেন, আবার হারিয়েও যান। মূল আয়োজনে তাতে বিশেষ তফাত হয় না। তবে কোথাও না কোথাও ঠিকই থেকে যায় শূন্যতা। এই খুচরো আয়োজনগুলোও আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। ধরা যাক এবারের অমর একুশে বইমেলার কথা।

বেহালাভর্তি ব্যাগ নিয়ে দুপুর রোদে নগরের পথে পথে সুর তোলেন সালাউদ্দিন
ছবি: প্রথম আলো

টিএসসির দিকের প্রবেশপথে প্রায় প্রতিদিনই হাতে বানানো ‘বেহালা’ বাজান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। এত ভিড়, মাইকের ঘোষণা, কথোপকথনের শব্দ ছাপিয়ে রুগ্‌ণ বেহালার সে সুর মিশে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরের বিপুল আয়োজনে। হাতে সময় থাকলে মেলায় আসা ব্যক্তিরা হয়তো দাঁড়ান কিছুক্ষণের জন্য। শুনে যান নড়বড়ে যন্ত্রের ভেতর থেকে উঠে আসা দেশাত্মবোধক কোনো গানের দরদি সুর।

চারটি তারের শর্ত নিয়ে বেহালা তৈরি হলেও সালাউদ্দিনের বেহালার তার একটি। এই এক তারেই সব কটি স্বর তোলা সম্ভব বলে জানান তিনি। কথা অবশ্য মিথ্যে নয়। মিরপুরের বাসিন্দা বেহালাবাদক ও তৈরির কারিগর সালাউদ্দিন শতাধিক গানের সুর তুলতে পারেন এক তারেই। এর মধ্যে আবার আছে দেশাত্মবোধক গানের কঠিন টানের সুর। আশ্চর্য এই যন্ত্রের আবিষ্কারক তাঁর পূর্বপুরুষ।

মেলা না থাকলে কী করেন, তা জানতে চাইলে প্রথম আলোকে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার বয়স ৬০ চলছে। বেহালা বানানো আর বাজানো ছাড়া জীবনে তো আর কিছু শিখিনি। ঢাকা শহরের এমন কোনো রাস্তা নেই যে আমি বেহালা নিয়ে হাঁটিনি। এই শহরের সব রাস্তাঘাট আমার বাজনা শুনেছে। কবে থেকে যে শুরু, স্মৃতিতে নেই। আমার বাবা মনু মিয়া বেহালা বানাত, দাদা বাচ্চু মিয়া ব্রিটিশ আমলে এই বেহালাই বানাত। মেলার মৌসুমে আয় একটু বাড়ে। বড়-ছোট হিসাবে একেকটা বেহালা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। মেলার সময় প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার টাকার মতো উপার্জন করি।’

‘কাঁধে বেহালাভর্তি ব্যাগ নিয়ে এখন রোদের মধ্যে হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। দুপুরের দিকে গরমের তাপ বাড়লে পা চলতে চায় না। কিন্তু মানুষ আমাকে ভালোবাসে।’
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, বইমেলার প্রবেশমুখের বেহালাবাদক

সালাউদ্দিনের দুই সন্তানের একজন এসএসসি পাস করেছে। আরেকজন পরীক্ষার্থী। উপার্জন করেন তিনি একাই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তবু তিনি অন্য কাজ করবেন না। আবার সন্তানদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখনই কাজ করতে দেবেন না। তবে এ কাজে যে পরিশ্রম অনেক, তা স্বীকার করলেন সালাউদ্দিন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁধে বেহালাভর্তি ব্যাগ নিয়ে এখন রোদের মধ্যে হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। দুপুরের দিকে গরমের তাপ বাড়লে পা চলতে চায় না। কিন্তু মানুষ আমাকে ভালোবাসে। বেহালার সুর শুনতে শুনতে মানুষের চোখে পানি দেখেছি। ভালো লাগার মুখ দেখেছি। তখন নিজের ক্লান্তির কথা মনে থাকে না।’

বইমেলার মাঠেই সদ্য কেনা বেহালা বাজিয়ে শোনালেন উম্মে সালমা তানজিয়া
ছবি: প্রথম আলো

তবে এই সালাউদ্দিনের ওপর কিছুটা মন খারাপ করেছেন এবারের মেলায় বই কিনতে আসা এক নারী। ১ মার্চ বিকেলে বইমেলার মাঠে দেখা গেল নীল শাড়ি পরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন তিনি। হাতে সালাউদ্দিনের বানানো বেহালা নিয়ে ১৩ নম্বর স্টল খুঁজছেন। সেখানে তাঁর পরিবারের একজন সদস্যের বই কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। কর্মস্থল থেকেই বইমেলায় চলে এসেছেন উম্মে সালমা তানজিয়া। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক তানজিয়া নিজে বেহালা বাজাতে জানেন বলে সালাউদ্দিনের বেহালার সুর শুনে কেনার আগ্রহ হয়েছে। কিন্তু এক তারেই সব স্বর বাজানোর কৌশল তো রপ্ত করেননি। বেহালা কিনেছেন, আপনজনের বই এসেছে, তবু মনঃক্ষুণ্ন কেন, জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু অনুরোধের পর উনি (সালাউদ্দিন) শুধু “সা রে গা মা” তুলতে শিখিয়ে দিলেন। একটা পুরো গান বাজাতে ইচ্ছা করছে। তা কিছুতেই শেখাবেন না। অবশ্য এটা তো তাঁর পেশা। তবে মেলার মাঠে একটা ছোট্ট বেহালা নিয়ে ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে আমার।’

তানজিয়া বেহালা বাজানোর সময় কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছেন। তাঁরা সুর শুনে জটলার ভেতরে এসেছেন, কিন্তু কিনে বাজানো শেখার কথা হয়তো ভাবেননি। বইমেলায় আসা ব্যক্তিদের কিছুক্ষণের জন্য মন ভালো করে দেওয়া মানুষেরা আমাদের স্মৃতিতে সাধারণত দীর্ঘস্থায়ীভাবে থাকেন না। যখন শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা হতো, তখন রাজার বেশে আসতেন এক বয়স্ক মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁশি বাজাতেন সেই নকল রাজা। অনেকেরই স্মৃতিতে থাকবে মানুষটির কথা। কিন্তু তিনি যে এখন আর মেলায় আসেন না, তাঁর বাঁশি যে আর বাজে না, তাতে খুব বিশেষ কিছু কমতি হয়নি আয়োজনের। শুধু বইমেলার মধ্যেও বাঁশি বাজার সংস্কৃতিটা নাই হয়ে গেল। আর সেই সময় মেলায় আসা কারও কারও স্মৃতিতে আছে ওই মানুষ আর তাঁর বাঁশির সুর।

‘সেই যে রাজার পোশাকে কোনো কিছু ছাড়াই মানুষকে অকাতরে আনন্দ দিতেন, বাঁশি বাজানো সে মানুষটি আসে এখন?’
আলতাফ হোসেন, সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি ইয়াছিন কলেজ, ফরিদপুর

কথা হচ্ছিল ফরিদপুরের ইয়াছিন কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেওয়া আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। মেলার খোঁজখবর জানতে জানতে আকস্মিকই তাঁর স্মৃতিতে এল সেই মানুষটির কথা। এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘সেই যে রাজার পোশাকে কোনো কিছু ছাড়াই মানুষকে অকাতরে আনন্দ দিতেন, বাঁশি বাজানো সে মানুষটি আসে এখন? তখনই তো কত বয়স হয়েছিল। কে জানে কোথায় বাড়ি মানুষটার। তাঁর বাঁশির সুর আর এখন শোনা যায় না, তাই না?’ একদিন ওই নকল রাজার সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন বলেও জানান আলতাফ হোসেন।

এক দশক আগে বাঁশিওয়ালার সঙ্গে ছবি তুলে স্মৃতি ধরে রেখেছেন আলতাফ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

এই যে এখন বাঁশের সঙ্গে ধনুকের মতো বেঁধে দেওয়া এক তারের বেহালা যন্ত্রটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মেলার প্রবেশমুখে সালাউদ্দিন, হয়তো পরের মেলায় অনুপস্থিত থাকতে পারেন তিনি। সুর শুনে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াবেন না বইমেলায় আসা ব্যক্তিরা। সে মেলায় প্রথম আসা শিশুটি জানতেই পারবে না বইমেলা মানে শুধুই বই নয়, বেহালা আর বাঁশির সুরও। শিশুটি জানবে না ওর পূর্বসূরি কেউ এসব মানুষের সঙ্গে ছবি তুলে রেখেছে স্মৃতি হিসেবে।