খোলা আকাশের নিচে জীবনযুদ্ধ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২৫ মার্চ কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় থাকা মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিরুপায় হয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে পাশের ফুটপাতে ওয়াসার পাইপের ভেতরে। গতকাল দুপুরে।  ছবি: হাসান রাজা
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২৫ মার্চ কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় থাকা মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিরুপায় হয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে পাশের ফুটপাতে ওয়াসার পাইপের ভেতরে। গতকাল দুপুরে। ছবি: হাসান রাজা

কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের প্রবেশপথের কলাপসিবল গেটগুলো আটকে রাখা। ভেতরে খাঁ খাঁ নির্জনতা। চিরচেনা যাত্রীর ভিড়, কুলিদের হাঁকডাক কিছু নেই। স্টেশনকেন্দ্রিক নানা কাজকর্মে যুক্ত থাকা প্রায় শ পাঁচেক মানুষের বসতিও ছিল এখানে। সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। কোথায় গেল তাঁরা? ফটকের পাশে কর্তব্য পালনরত নিরাপত্তাকর্মীরা জানালেন, করোনার কারণে ২৫ মার্চ তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।

স্টেশনের উত্তর পাশেই ৬ নম্বর বাস টার্মিনাল। রাজধানীতে এখন গণপরিবহন চলাচল বন্ধ। সড়কের দুই পাশ দিয়ে ৬ নম্বর রুটের বড় বাসগুলো সারি দিয়ে রাখা। তাতে রীতিমতো দেয়ালের মতো আড়ালের সৃষ্টি হয়েছে। সেই আড়ালের ওপারেই আপাতত সংসার পেতে বসেছেন কমলাপুর রেলস্টেশন ও কলোনির ভেতর থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দেখা গেল, খোলা আকাশের নিচে তাঁদের মানবেতর জীবনযুদ্ধের দৃশ্য।

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উত্তর দিকের লম্বা সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে চলছে ওয়াসার মোটা পাইপ বসানোর কাজ। ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে সড়ক খুঁড়ে রাখা। তার পাশ দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে পাইপগুলো। কড়া রোদ থেকে আড়াল পেতে সেই পাইপের ভেতরে শুয়ে-বসে ছিলেন অনেকে। রেলওয়ে ডাকঘরের অপর পাশের ফুটপাতে ওয়াসার লাইন থেকে কল বসানো হয়েছে। সেখানেই ভিড় করে কেউ কেউ গোসল করছেন, কেউ সেরে নিচ্ছিলেন কাপড়, থালাবাটি ধোয়ার কাজ। ফুটপাতের পাশ দিয়ে রেল কলোনির দেয়াল, অন্যদিকে গাড়ির সারি। মাঝখানে পাইপের ভেতরে আশ্রয় মিললেও এই ছিন্নমূল মানুষদের খাবারের সংকট প্রচণ্ড। স্টেশনের কুলি বাদশা মিয়া বলছিলেন, কোনো দিন এক বেলা খেয়ে, কোনো দিন না খেয়ে তাঁদের দিন কেটে যাচ্ছে। রাতে নারীরা পাইপের ভেতরে থাকেন, আর অধিকাংশ পুরুষ থাকেন পাশেই শাহ ফরিদ মসজিদের সামনের খেলা প্রাঙ্গণে। গত সোমবার থেকে মসজিদে জামাতের নামাজ হচ্ছে না। তাঁরা শঙ্কিত, এরপর হয়তো রাতে তাঁদের সেখানেও থাকতে দেওয়া হবে না।

কথা হলো মো. জুলহাশের সঙ্গে। তিনি স্টেশনে ‘বক্সলোডার’–এর কাজ করতেন, কাজটি হলো টেনের গার্ডদের জন্য বাক্স তুলে দেওয়া। প্রতিটি বাক্সের জন্য ৩০ টাকা করে পেতেন। তিনি রেলের স্থায়ী কর্মী নন। দিনে প্রায় ৪০০ টাকা আয় হতো। স্টেশনেই থাকতেন পরিবার নিয়ে। স্টেশন বন্ধ থাকায় কাজ গেছে, আশ্রয়ও গেছে। স্ত্রী চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ফুটপাতের পাশে পাইপের ভেতরে থাকেন, তিনিও দিনে তাঁদের সঙ্গেই থাকেন। রাতে ঘুমাতে যান শাহ ফরিদ মসজিদের প্রাঙ্গণে।

পাইপের ভেতরে মাথা গুঁজে ছিলেন তানিয়া বেগম। তিনি কমলাপুরেই একটি পোশাক কারখানার সেলাই মেশিন অপারেটর। তাঁর স্বামী রাসেল রেলস্টেশনের কুলি। রেল কলোনির ভেতরেই তাঁরা থাকতেন। সেখান থেকে তাঁদেরও গত মাসের ২৫ তারিখে উচ্ছেদ করা হয়েছে। চারজনের পরিবারটি থালাবাটি নিয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালেন উচ্ছেদ হওয়া অনেকেই তাঁদের সংসারের জিনিসপত্র একত্র করে আপাতত স্টেশনের ভেতরের এক জায়গায় রেখে এসেছেন। খেদের সঙ্গে বললেন, তাঁরা ভিক্ষুক নন, খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু এখন থাকার জায়গা নেই, খাবারের জন্যও হাত পাততে হচ্ছে।

এখানে কথা হলো শান্তিনগরের পোশাক কারখানার কর্মী রাজিয়া, স্টেশনের কুলি আলমগীর হোসেন, রিকশাচালক দেলোয়ার, গৃহকর্মী জ্যোৎস্না, খুকীসহ অনেকের সঙ্গে। জানালেন, তাঁরা অধিকাংশই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। হাতের সঞ্চয় তেমন নেই, যা ছিল তা প্রায় শেষের পথে। বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো কোনো দিন এখানে খিচুড়ি দেওয়া হয়। সেই অনিশ্চিত খাবারের আশাতেই থাকেন তাঁরা। দুঃখ করে তাঁরা বললেন, নিরাপত্তার জন্য সবই যখন ঘরের ভেতরে থাকছে, তখন তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আশ্রয় থেকে। পথে পড়ে আছেন খাদ্যহীন, নিরাপত্তাহীন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, কষ্ট বোঝারও কেউ নেই!

এই এলাকা পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। এলাকার দুস্থ ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে জানালেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর। তিনি বললেন, ডিএসসিসি থেকে ৫০০ ব্যাগ, আবদুল মোমেন লিমিটেডের পক্ষ থেকে পাওয়া ৫০০ ব্যাগ, বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া ত্রাণসামগ্রীসহ প্রায় দুই হাজার ব্যাগ ত্রাণ তাঁরা বিতরণ করেছেন। এই এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় ত্রাণসামগ্রী পরিমাণ খুব স্বল্প। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষদের প্রতিদিনই রান্না করা খাবার সরবরাহ করছেন।