গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে কেন মামলা কম

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার রাস্তায় নানা অনিয়মের কারণে মামলার ও জরিমানার নজির আছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে দোষী বাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা হয় খুবই কম।

অন্তত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ট্রাফিক পুলিশের হিসাব বলছে তাই। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে শিক্ষার্থীদের ঢাকার সড়ক অবরুদ্ধ করে ফেলার পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণীত হয়। কিন্তু এরপরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে মামলার সংখ্যা খুবই নগণ্য।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৮০ অনুসারে, গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করা একটি অপরাধ। আইন অমান্যকারীকে অনধিক ১ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
এ আইনের অধীনে মামলা যা হয়, তা মূলত করা হয় বিআরটিএর মাঝেমধ্যে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। ট্রাফিক পুলিশের এ-সংক্রান্ত মামলা খুবই নগণ্য।

ঢাকার রাস্তায় ‘ওয়েবিল’-এর অজুহাতে বিআরটিএ নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া এড়িয়ে চলে বেশ কিছু পরিবহন। ওয়েবিল বলতে বোঝায় কোনো বাসে নির্দিষ্ট দূরত্বে চড়ে যাওয়া যাত্রীদের তালিকা, যা নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর পরীক্ষা করা হয় এবং সেই দূরত্বের জন্য নির্দিষ্ট ভাড়া বেঁধে দেন পরিবহনমালিকেরা।

এই ওয়েবিলের নামে আগে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার নজিরও আছে। অথচ আগে বিআরটিএ সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করেছিল ৭ টাকা। গত রোববার পরিবহনমালিকদের ধর্মঘটের কারণে সে ভাড়া বাড়িয়ে করা হয় ১০ টাকা।

সর্বনিম্ন ভাড়া না মানা ও অতিরিক্ত ভাড়া রাখা পরিবহনের মধ্যে বিকাশ ও ভিআইপি পরিবহনের কথাই ধরা যাক। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ পুরোনো। আজিমপুর থেকে আবদুল্লাহপুর যায় বিকাশ, আর গাজীপুর যায় ভিআইপি।

বিকাশ পরিবহনে মঙ্গলবার দুপুরে আহমেদ রাব্বি আসাদগেট থেকে মহাখালী যাচ্ছিলেন। গুগল ম্যাপ অনুসারে এ পথের দূরত্ব ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এখানে সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ১৫ টাকা। কিন্তু তিনি ভাড়া দিয়েছেন ৩০ টাকা, অর্থাৎ নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ।

আহমেদ রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগেও এই বাসে আমি যতবার আসাদগেট থেকে মহাখালী গিয়েছি, প্রত্যেকবার ২৫ টাকা করে ভাড়া রেখেছে। এর নিচে নাকি ভাড়া নাই।’

বিকাশের সেই পরিবহনের চালকের সহকারী সাদ্দাম খান প্রথম আলোকে বলেন, আগে তাঁর বাস বিআরটিএর অভিযানে পড়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য কখনো জরিমানা হয়নি।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায় সরকার। এরপর পরিবহনমালিকদের দাবির মুখে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ মহানগরগুলোতে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ায় বিআরটিএ। মহানগরে বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারে বাড়িয়ে করা হয় ২ টাকা ১৫ পয়সা, মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা।

আর ঢাকায় মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া হচ্ছে ৮ টাকা। আর বড় বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া হচ্ছে ১০ টাকা।

ট্রাফিক পুলিশের মামলার নজির কম

ঢাকার ভেতর ও ঢাকা থেকে নিকটবর্তী জেলায় চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাস ছেড়ে যায় মোহাম্মদপুর ও আজিমপুর এলাকা থেকে। এই দুটি এলাকা যথাক্রমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের তেজগাঁও ও লালবাগ বিভাগের অধীনে।

পরিসংখ্যান বলছে, লালবাগ ট্রাফিক পুলিশ অক্টোবরে মামলা করেছে ২ হাজার ৪০৬টি। কিন্তু এসব মামলার একটিও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে হয়নি।
মামলাগুলোর ১ হাজার ২৬২টি হয় চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানো-নামানো ও রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরির কারণে। এ ছাড়া গাড়ি চালানোর সময় চালকের মোবাইলে কথা বলা ও সিটবেল্ট না বাধার কারণে ৫৯৬টি মামলা হয়।

এবার ট্রাফিক পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের পরিসংখ্যানে চোখ রাখা যাক। অক্টোবরে তারা মামলা করেছে ৪ হাজার ৬১টি। এখানেও কোনোটিই অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে হয়নি।

অধিকাংশই মামলা হয় চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানো-নামানো ও রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি-সংক্রান্ত কারণে, মামলা সংখ্যা ২ হাজার ৬৯৯টি। এ ছাড়া গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা ও সিটবেল্ট না বাঁধার জন্য ৫৩৪টি, অতিরিক্ত গতির জন্য ৫১১টিসহ বিভিন্ন কারণে বাকি মামলাগুলো হয়।

অন্য যেসব কারণে মামলা হয় সেগুলো হচ্ছে লাইসেন্স না থাকা, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, পরিবেশদূষণকারী কালো ধোঁয়া নির্গমনসহ আরও কিছু কারণে।

অক্টোবরে ১৩৬টি বাস-মিনিবাসের বিরুদ্ধে মামলা করে ট্রাফিক পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। বেশির ভাগই মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে, ২ হাজার ২৯০টি। এ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির বিরুদ্ধে ৬১১টি, ভাড়ায় চালিত সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪০৫টি।

লালবাগ ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার মোহা. মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসের ভাড়া নিয়ে সেভাবে জরিমানা হয় না। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে বেশির ভাগ অভিযোগ সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে আসে। কিন্তু বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে আগে খুব একটা অভিযোগ আসেনি।’

তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার মো. সাহেদ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীরা অভিযোগ করলে আমরা মূলত থানায় হস্তান্তর করে দিই। কিন্তু সেখানে মূলত যাত্রীরা আর মামলা করতে চান না। নিজেরাই পরে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন দ্রুত গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য।’

অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ টুকটাক যেসব মামলা করে, তার বেশির ভাগই হয় পুলিশ সপ্তাহসহ নানা উপলক্ষে।

সামান্য মামলা করছে বিআরটিএ

অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে কিছু মামলা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে এ তোড়জোড় কিছুটা বেড়েছে সম্প্রতি, ভাড়া বৃদ্ধির পর আবার অতিরিক্ত ভাড়া রাখার অভিযোগে।

২০২০-২১ অর্থবছরে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ হাজার ৬৪৬টি অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানে মামলা হয় ১৯ হাজার ১৮টি। জরিমানা হয় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা।

তবে এগুলোর কতটি অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে, এর সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।
বিআরটিএতে দীর্ঘ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার অভিজ্ঞতা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাজিদ আনোয়ারের। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, সাধারণ সময়ে মাসে গড়ে ৩০০টির মতো মামলা করেন।

এসব মামলার মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে, যা মোট মামলার প্রায় ১০ শতাংশ।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাজিদ আনোয়ার বলেন, ‘আমরা সাধারণত সরকারনির্ধারিত ভাড়ার চার্টটা পরীক্ষা করি। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার ব্যত্যয় পেলে জরিমানা করি।’

বিআরটিএর মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুট পারমিট না মেনে অন্য রাস্তায় গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, নির্ধারিত আসনের তুলনায় বেশি আসন ইত্যাদি কারণে।

কী বলছেন পরিবহনমালিকেরা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে মালিকদের সঙ্গে আজ বুধবার বৈঠকে বসেছেন তাঁরা।

কিন্তু আগেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব বৈঠক কতটা কাজে আসবে—এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আগেও আমরা রাস্তায় নেমেছি। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে রাস্তায় অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করেছি।’

তারপরও অনেক বাসই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। তাহলে কি পরিবহনমালিকেরা কথা শুনছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন বলেন, ‘কোনো ক্ষেত্রে মালিকেরা, শ্রমিকেরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এটা মালিক–শ্রমিক উভয়ের দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করতে হবে।’

অতিরিক্ত ভাড়া আদায় সম্পর্কে মামলার বিষয়ে বিআরটিএর একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত ড্রাইভার, সহকারীকে মামলা দিয়ে লাভ হয় না। সরাসরি পরিবহনমালিককে মামলা ও জরিমানা না করলে সমস্যার সুরাহা কঠিন।