গত বছর ৫৬২৯ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭৮০৯

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিআরইউর সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলনে ‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১’ প্রকাশ করে
ছবি: প্রথম আলো

২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৮০৯ জন। আহত হয়েছে ৯ হাজার ৩৯ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই সড়কে ঘটছে। আজ রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১’ প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্য গত বছর ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও আগের বছরের তুলনায় জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা আড়াই শতাংশ বেড়েছে। মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ শতাংশ ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩৯ শতাংশ। দুর্ঘটনার ৩০ শতাংশ ঘটেছে ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ড ভ্যানে। জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সংকলিত করে এসব তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১’-এ বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ২১৩টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫১৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৯ হাজার ৭৫১ জন। ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন নিহত এবং নৌপথে ১৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে যানবাহনের বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কে চাঁদাবাজি, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়াসহ সড়ক দুর্ঘটনা ব্যাপক হারে বাড়ার ১৬টি কারণ তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা এখন দেশের জন্য করোনা মহামারির চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারির চেয়ে সড়কে বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও, সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের কার্যক্রম করোনা বা জঙ্গি নিয়ন্ত্রণের মতো দৃশ্যমান নয়। মেট্রোরেল, সড়ক-সেতু সংস্কারসহ যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় জনদুর্ভোগ, দুর্ঘটনা দুটিই বেড়েছে।

সংগঠনের বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২১-এর তথ্য অনুসারে, দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশের বেশি ঘটছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। প্রায় ১১ শতাংশ বাস; প্রায় ১০ শতাংশ নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা, ট্রাক্টর ও লেগুনা; প্রায় ৯ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা; প্রায় ৯ শতাংশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক এবং ৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি, স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকল (এসইউভি) ও মাইক্রোবাস সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে পথচারীরা, ১ হাজার ৪৩১ জন। আগের বছরের তুলনায় পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে ১ শতাংশের বেশি। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল ৬ হাজার ৬৮৬ জন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাদিউজ্জামান বলেন, সড়ক টেকসই ও আধুনিকায়নের জন্য সরকার যা বিনিয়োগ করছে, তার ফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও পরিবহনমালিক-চালক যখন যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করতে থাকেন, তখন বুঝতে হবে এ দেশে দুর্ঘটনা শুধু কারিগরি সমস্যা নয়, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ও জড়িত। নীতিনির্ধারকেরা ভারতে সড়কে দেড় লাখ মৃত্যুর তথ্য টানেন। অথচ ভারতে প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আর বাংলাদেশ তা ৪৫। অন্য দেশগুলো যখন গণপরিবহনমুখী উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে, তখন এ দেশে মোটরসাইকেলমুখী উন্নয়ন চলছে। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকারি রাজনৈতিক দলের যে যোগাযোগ, তার ভিত্তিতে পরিবহন খাতের ব্যক্তিরা জনগণকে মানুষ বলে মনে করছেন না। তাঁরা জনগণের পকেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন। এই পেশিশক্তির হাত থেকে সড়ক ও যাত্রীদের রক্ষা করতে হবে। সড়ক উন্নয়ন বাজেট যতই বরাদ্দ হোক না কেন, দুর্ঘটনা রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বোর্ডে একসময় সম্মানসূচক সদস্য ছিলেন আবদুল হক। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন তৈরি করার কথা। সে কাজটিও ঠিকভাবে করা হয়। কোনো জবাবদিহি নেই। সড়ক দুর্ঘটনাকে জাতীয় জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক মনজুরুল আলম এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শরীফুজ্জামান শরীফ। সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা, নতুন গণপরিবহন নামানো, দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় তহবিল গঠন ইত্যাদি। দূরত্বের তুলনায় অনেক বেশি ভাড়া নেওয়া হয় অভিযোগ তুলে অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়কগুলোতে দূরত্ব মেপে কত টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে এক সপ্তাহের মধ্যে মাঠে নামবে।