গাড়িবিলাসে ঢাকার দুই সিটি

৮৬ জন কর্মকর্তা প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি ব্যবহার করছেন। দক্ষিণ সিটির সিইওর স্ত্রীও ব্যবহার করেন করপোরেশনের গাড়ি।

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) একটি প্রাইভেট কার পাওয়ার কথা। তবে দক্ষিণ সিটির সিইও প্রায় কোটি টাকা দামের একটি স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল ব্যবহার করেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ব্যবহার করেন করপোরেশনের একই মডেলের আরেকটি গাড়ি
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফরিদ আহাম্মদ করপোরেশনের দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। একটিতে তিনি নিজে চলাফেরা করেন, আরেকটি ব্যবহার করেন তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।

এই দুটি গাড়ির পেছনে করপোরেশনের জ্বালানি তেল খরচ মাসে প্রায় দেড় হাজার লিটার, যার এখনকার দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। দুই গাড়ির দুজন চালকের বেতন-ভাতাবাবদ ব্যয় তো রয়েছেই। সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ সিটির সিইও সরকারের কাছ থেকে বিনা সুদে ঋণ নিয়েও গাড়ি কিনেছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে ফরিদ আহাম্মদ গাড়ির প্রাধিকারভুক্ত, অর্থাৎ তিনি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। তবে তাঁর পরিবার গাড়ির প্রাধিকারভুক্ত নয়। আর করপোরেশনের বিধি অনুযায়ী, সিইও পেতে পারেন একটি কার (প্রাইভেট কার)। যদিও তিনি ব্যবহার করেন করপোরেশনের একটি স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি), যার মডেল মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস। তাঁর স্ত্রীর ব্যবহারের জন্য একই মডেলের একটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে। একেকটি গাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য ৯৯ লাখ টাকার মতো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এসইউভি জিপ নামেই পরিচিত। যদিও জিপ একটি ব্র্যান্ডের নাম।

গাড়ি ব্যবহারে এই বিলাসিতা চলছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই। প্রাধিকার তালিকায় না থেকেও দক্ষিণ সিটির অন্তত ৪৫ জন কর্মকর্তা করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করছেন। উত্তর সিটিতে সংখ্যাটি ৪১। একাধিক কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরাও করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে বিনা সুদে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সেটির বদলে করপোরেশনের গাড়ি নিয়ম ভেঙে ব্যবহার করছেন। আবার করপোরেশনের অ্যাম্বুলেন্সও ব্যক্তিগত চলাচলে ব্যবহার করা হয়।

এই অনিয়ম ও বিলাসিতার চিত্র পাওয়া গেছে দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগের প্রতিবেদন এবং উত্তর সিটির ‘অফিশিয়াল’ গাড়ির বিবরণ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদনে। পাশাপাশি দুই সিটির পরিবহন পুলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গাড়িচালকের সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

দুটি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির সিইও ফরিদ আহাম্মদ গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকারভুক্ত। দুটি গাড়ি ও দুজন চালক তাঁর জন্য। অবশ্য একই দিন সিইওর নামে বরাদ্দ করা দ্বিতীয় গাড়ির চালক এনায়েত খানের সঙ্গে বেলা দেড়টার দিকে কথা হয়। এই চালক বলেন, তিনি গাড়ি নিয়ে সিইওর মোহাম্মদপুরের বাসায় অবস্থান করছেন। তাঁর দায়িত্ব হলো সিইওর স্ত্রীর জন্য গাড়িটি চালানো। বিষয়টি জানানোর পর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে সিইও বলেন, সচিবের স্ত্রী কি রিকশায় চলাচল করবেন।

দক্ষিণ সিটির নথিতে দেখা যায়, সিইও যে গাড়ি ব্যবহার করেন, তা তাঁর নিজের নামেই বরাদ্দ রয়েছে। আর স্ত্রীকে যে গাড়িটি ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সেটার বরাদ্দের ঘরে সিইওর দপ্তর লেখা আছে। সূত্র জানায়, দ্বিতীয় গাড়িটি সিইওর স্ত্রী ব্যবহার করেন। এটা শুধু বর্তমান সিইওর সময়ে হচ্ছে তা নয়, অতীতেও সিইওরা একইভাবে গাড়ি ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যত আগে থেকে চলুক, এটি অনিয়ম।

কী নিয়ম

সিটি করপোরেশনে কোন কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা গাড়ি সুবিধা পাবেন, তা নিয়ে অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের একটি প্রাধিকার তালিকা ছিল। এর আনুষ্ঠানিক নাম টেবিল অব অর্গানোগ্রাম অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট (টিওঅ্যান্ডই)। ২০১১ সালে দুই সিটি ভাগ হওয়ার পর আলাদাভাবে কোনো টিওঅ্যান্ডই হয়নি। এ ধরনের প্রাধিকার তালিকা করলে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সর্বশেষ ১৯৯০ সালে অনুমোদিত প্রাধিকার তালিকা অনুযায়ী, করপোরেশনে সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান শুধু মেয়র। সিইও, প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা অফিসের কাজের জন্য একটি করে গাড়ি (কার) পেতে পারেন। একান্ত সচিব, জনসংযোগ কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা—এঁরা সবাই মিলে ব্যবহার করতে পারেন একটি গাড়ি (কার)। এর বাইরে প্রকৌশল বিভাগের জন্য ১৩টি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য ১টি, স্বাস্থ্য ও মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের জন্য ১টি, জরুরি কাজে পরিবহন পুলে ১টি করে এসইউভি এবং সড়কবাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্পত্তি বিভাগে তিনটি পিকআপ ভ্যান থাকবে। কর্মকর্তাদের অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য তিনটি মাইক্রোবাস ও দুটি স্টাফ বাস থাকার কথা বলা হয়েছে প্রাধিকার তালিকায়।

দক্ষিণ সিটির চিত্র

দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগের প্রতিবেদন ও প্রাধিকার তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও ব্যবহার করছেন সিটি করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামান (এসইউভি ধরনের গাড়ি ব্যবহার করেন), মেয়রের একান্ত সচিব মো. মারুফুর রশিদ খান (এসইউভি), আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সুয়ে মেন জো (এসইউভি), শহিদুল ইসলাম (এসইউভি), শাখাওয়াত হোসেন সরকার (কার), মেরিনা নাজনীন (ডাবল কেবিন পিকআপ), হায়দার আলী (ডাবল কেবিন পিকআপ), বাবর আলী মীর (ডাবল কেবিন পিকআপ), প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন (ডাবল কেবিন পিকআপ), প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্বে থাকা সিরাজুল ইসলাম (এসইউভি), আইন কর্মকর্তা খায়রুল হাসান (এসইউভি), প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব (এসইউভি) এবং প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মুনান হাওলাদার (ডাবল কেবিন পিকআপ)।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তুলনামূলক নিম্ন পদে কর্মরত থেকেও গাড়ি ব্যবহার করা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবু তৈয়ব রোকন, উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শাহ জাহান আলী, প্রটোকল কর্মকর্তা মো. দাউদ হোসেন ও সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান।

গাড়ি ব্যবহার নিয়ে এসব কর্মকর্তার কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের যুক্তি হলো, করপোরেশন থেকে পেয়ে তাঁরা গাড়ি ব্যবহার করছেন। কেউ আবেদন করেননি।

দক্ষিণ সিটির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন জনপ্রশাসনের একজন সিনিয়র সহকারী সচিব। তিনি যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটি একটি এসইউভি। জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার পরিদর্শনের কাজে তিনি এই গাড়ি ব্যবহার করেন।

অবশ্য দক্ষিণ সিটি সূত্রের দাবি, এই কর্মকর্তা সব সময় গাড়িটি ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী উপসচিব হয়ে তিন বছর চাকরির পর একজন কর্মকর্তা গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদের ঋণসুবিধা প্রাপ্য হন। অথচ করপোরেশনে প্রেষণে এসে একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এসইউভি ব্যবহার করছেন।

উত্তর সিটির মেয়রের একান্ত সচিব শাহ মোজাহিদ উদ্দিনও একটি এসইউভি ব্যবহার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পদের বিপরীতে গাড়ি বরাদ্দ আছে। অবশ্য বিধি ঘেঁটে দেখা গেছে, এই পদের বিপরীতে গাড়ি নেই।

উত্তর সিটির চিত্র

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের যেসব কর্মকর্তা প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি ব্যবহার করছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক, প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) মিজানুর রহমান, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জুলকার নায়েন, জিয়াউর রহমান, আবদুল্লাহ আল বাকী ও আবেদ আলী, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম, আইন কর্মকর্তা তাসনুভা নাশতারান, সিস্টেম অ্যানালিস্ট তুহিনুল ইসলাম, রাজস্ব কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন, উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মৃধা এবং সম্পত্তি কর্মকর্তা আল-বশিরুল ইসলাম।

উত্তর সিটির সিইও করপোরেশন থেকে একটি প্রাইভেট কার পাওয়ার যোগ্য। তবে তিনি ব্যবহার করেন একটি স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এই কর্মকর্তারা সবাই এসইউভি ব্যবহার করছেন। তাঁদের যুক্তি হলো, করপোরেশন গাড়ি দিয়েছে, তাই তাঁরা ব্যবহার করছেন। কেন তাঁদের গাড়ি দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সিইও সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেশনের কাজের স্বার্থেই কর্মকর্তাদের নামে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাতারাতি তো সব গাড়ি বাতিল করা যাবে না। তিনি দাবি করেন, গাড়ি বরাদ্দসংক্রান্ত বিধি হালনাগাদ করে বিষয়টি অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুমোদনের আগে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া বেআইনি।

উল্লেখ্য, করপোরেশনের টিওঅ্যান্ডই অনুযায়ী উত্তরের সিইও একটি ‘কার’ (প্রাইভেট কার) পেতে পারেন। কিন্তু সিইও সেলিম রেজা ব্যবহার করছেন একটি বিলাসবহুল এসইউভি।

চারটি গাড়ি ‘ঘুষ’

সংস্থা পরিচালনায় গাড়ির ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুমোদন না নিয়েও কীভাবে প্রতিনিয়ত গাড়ি কেনা হচ্ছে এবং কর্মকর্তাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। তাঁরা যে যুক্তি দেখিয়েছেন, তা হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গাড়ির চাহিদা দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। করপোরেশনের কাজের পরিধি বেড়েছে, তাই বাড়তি গাড়ি দরকার।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গাড়ি কত দরকার, কে কে পাবেন, তা ঠিক করবে সরকার। অনুমোদিত টিওঅ্যান্ডই ছাড়া কোনো সরকারি সংস্থায় গাড়ি ব্যবহার করা যায় না বলে উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও চাকরিসংক্রান্ত বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, টিওঅ্যান্ডই তৈরি করে সংস্থা প্রথমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। এরপর সেটি যাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দিলে তা যাবে সচিব কমিটিতে। তৃতীয় ও তার ওপরের গ্রেডের ক্ষেত্রে বিষয়টি যাবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য। এই প্রক্রিয়া অনুসরণের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সরকারি আদেশ (জিও) জারি করবে।

ঢাকার দুটি সিটি বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে গাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিধি অনুসরণ করেনি। তার বদলে দুই সিটি করপোরেশন থেকে দুটি করে চারটি গাড়ি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এর জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং চালকের বেতন বহন করা হয় করপোরেশনের তহবিল থেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি মূলত ঘুষ, যাতে গাড়ি কেনা ও ব্যবহার নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রশ্ন না তোলা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ সিটি থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগে ব্যবহারের জন্য দেওয়া একটি গাড়ি ব্যবহার করেন বিভাগের নগর উন্নয়ন-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী (যুগ্ম সচিব)। এই শাখা থেকেই সিটি করপোরেশনের বিষয়াদি তদারকি করা হয়। সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা আগে থেকেই চলে আসছে। কাজটি নিয়মের ব্যত্যয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা তো অবশ্যই।’

বিনা সুদে গাড়ি, করপোরেশনেও গাড়ি

সরকারের উপসচিব ও তাঁর ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের গাড়ি কিনতে বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া শুরু হয় ২০১৭ সালে। এই গাড়ি কেনার পর কর্মকর্তারা মাসে ৫০ হাজার টাকা পান জ্বালানি তেল ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ। সর্বশেষ নিয়মটি হলো, কেউ যদি দপ্তর বা সংস্থা থেকে ব্যবহারের জন্য গাড়ি পান, তাহলে তিনি সুদমুক্ত ঋণে কেনা গাড়ির বিপরীতে ৫০ হাজার টাকার জায়গায় ২৫ হাজার টাকা পাবেন। তবে কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য সুদমুক্ত ঋণে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। এসব নির্দেশনা দিয়ে ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা সরকারি যানবাহন ব্যবহারে অনিয়ম করছেন, তা অসদাচরণ ও দুর্নীতির আওতাভুক্ত অপরাধ।

সূত্র জানিয়েছে, দুই সিটির অনেক কর্মকর্তাই প্রেষণে এসেছেন। তাঁদের অনেকে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। উত্তর সিটির ১৫ জন কর্মকর্তা সরকারি বিনা সুদের ঋণে গাড়ি কিনেছেন। দক্ষিণ সিটিতে সংখ্যাটি কত, তা লিখিতভাবে জানতে চেয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি। বিনা সুদে ঋণে কেনা গাড়ি ও করপোরেশনের গাড়ি বিধি ভেঙে ব্যবহার—দুই মিলে কর্মকর্তাদের একাংশ দুটি গাড়ির সুবিধা পাচ্ছেন। এ জন্য সরকারকে আবার মাসে মাসে একেকজনের পেছনে ২৫ হাজার টাকা করেও ব্যয় করতে হচ্ছে।

জ্বালানি তেলেও ‘অনিয়ম’

২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (তখনকার সংস্থাপন) ‘সরকারি যানবাহনে জ্বালানির ব্যবহার’ শিরোনামে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তারা একটি গাড়িতে মাসে ২০০ লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে পারবেন। তবে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে প্রশাসনিক কাজ করতে না হলে জ্বালানি ব্যয় ১০ শতাংশ কম করতে হবে। অবশ্য ঢাকার দুটি সিটিতে গাড়ি যেমন বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি জ্বালানি তেল ব্যয় করা হচ্ছে ইচ্ছামতো।

দক্ষিণ সিটির সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবু তৈয়ব রোকন গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত নন। তবে তিনি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করেন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগের তৈরি করা নথি বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে করপোরেশনের সিইও নিজের ব্যবহৃত গাড়ির জন্য জ্বালানি খরচ করেছেন ৮৫০ লিটার। তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করা করপোরেশনের গাড়িতে জ্বালানি নেওয়া হয়েছে ৭৫০ লিটার। দক্ষিণ সিটিতে সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জ্বালানি ব্যবহার করেছেন মেয়রের একান্ত সচিব মারুফুর রশিদ খান, পরিমাণ ৭৮০ লিটার। দেখা যায়, বেশির ভাগ কর্মকর্তাই মাসে ৪০০ লিটারের বেশি জ্বালানি ব্যয় করেছেন।

গাড়িবিষয়ক ওয়েবসাইট কারদেখোডটকম বলছে, এক লিটার তেলে একটি মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট মডেলের গাড়ি সাড়ে ১৩ কিলোমিটার চলে। তবে দক্ষিণ সিটির যান্ত্রিক বিভাগ সূত্র বলছে, করপোরেশনের মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট মডেলের গাড়িগুলো ঢাকায় এক লিটার তেলে ৭ কিলোমিটারের মতো চলতে পারে। এ হিসাবে ৮৫০ লিটার তেলে মাসে গাড়ি চলতে পারে ৫ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার। দিনে গড়ে ১৯৮ কিলোমিটার।

উত্তর সিটির পরিবহন বিভাগের নথি বলছে, সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা ও প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম সাইদুর রহমান প্রতি মাসে প্রায় ৫৪০ লিটার করে জ্বালানি খরচ করছেন। বাকি কর্মকর্তাদের সবাই প্রতি মাসে কমবেশি ৪০০ লিটার জ্বালানি পোড়াচ্ছেন।

দুই সিটি কর্মকর্তাদের যুক্তি, সিটি করপোরেশন সেবামূলক সংস্থা। এখানে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। এ জন্য জ্বালানি খরচ হয় বেশি। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, জ্বালানি তেলের একটি বড় অংশ চুরি হয়। কর্মকর্তারা যেহেতু চালকদের পরিবারের কাজেও ব্যবহার করেন, সেহেতু তেল চুরি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।

গাড়ি কেনা বন্ধ হচ্ছে না

দুই সিটি জানিয়েছে, দক্ষিণে হালকা গাড়ি (কর্মকর্তারা যেসব গাড়ি ব্যবহার করেন) রয়েছে ৭৫টি। আর উত্তরে রয়েছে ৬৬টি। এরপরও নতুন করে গাড়ি কেনার প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। মাস চারেক আগেও ৫টি এসইউভি ও ৫টি ডাবল কেবিন পিকআপ কিনেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। সূত্র জানিয়েছে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পিকআপগুলোকে রূপান্তর করে কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে।

গাড়ি ব্যবহারে বিলাসিতা ও ইচ্ছেমতো জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংস্থার কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, কর্মকর্তাদের গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ বিধি অনুসরণ করে কাজ করতে ইতিমধ্যে সংস্থার সচিবকে আহ্বায়ক করে সম্প্রতি আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতেও একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন মেয়র।

শুধু দুই সিটি নয়, সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর ও সংস্থায় এভাবে ইচ্ছেমতো গাড়ি ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২৭ আগস্ট প্রথম আলোতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ‘নিরাপদ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি’ শীর্ষক প্রকল্পে গাড়ি ব্যবহারের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে তুলে ধরা হয়, সরকারি প্রকল্পের গাড়ি পরিচালকের স্ত্রী ব্যবহার করছেন। প্রকল্পের তিনটি গাড়ি কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় দুটি বিষয় পরিষ্কার, সিটি করপোরেশনে অভ্যন্তরীণ কোনো নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নেই। যাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিতের কথা, তাঁর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, বিনা সুদে গাড়ি কিনতে ঋণ দিয়ে আবার সংস্থা থেকে গাড়ি দেওয়া দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। জনগণের ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দামি দামি গাড়ি কেনাও অনৈতিক ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এটার নামও দুর্নীতি।