গোলাম আযমের দাফন, জানাজার সময় প্রতিবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক, মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমকে গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় রাজধানীর মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে জোহরের নামাজের পর বেলা একটা ৫০ মিনিটে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে গোলাম আযমের জানাজা হয়। এতে তাঁর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, জামায়াতে ইসলামীর বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক অংশ নেন।
দুপুর ১২টার পর জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে গোলাম আযমের মরদেহ নিয়ে মগবাজার থেকে বায়তুল মোকাররমের উদ্দেশে রওনা হন। পল্টন মোড়ে পৌঁছালে বায়তুল মোকাররমে এই জানাজা প্রতিহতের ডাক দেওয়া অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টস ফোরামের বিক্ষোভ মিছিল থেকে ক্ষুব্ধ এক তরুণ ছুটে গিয়ে লাশবাহী গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন। প্রেসক্লাব থেকে মিছিল করে আসার পর পুলিশ তাদের পল্টন মোড়ে আটকে দিয়েছিল। জামায়াতের কর্মীরা এদের ধাওয়া করার চেষ্টা করলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বেলা একটার দিকে লাশবাহী গাড়ি বায়তুল মোকাররম মসজিদে পৌঁছে।
গণজাগরণের একাংশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, বৃত্তান্ত একাত্তর মিছিল করে বায়তুল মোকাররম যেতে চাইলে প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। পরে সংগঠনগুলো প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করে। তারা বায়তুল মোকাররমে গোলাম আযমের জানাজার সুযোগ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটও বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে তারা বায়তুল মোকাররমের দিকে যেতে চাইলে পল্টন পুলিশ বক্সের সামনে আটকে দেয়। সেখানে দাঁড়িয়েই তারা বিক্ষোভ করে।
গোলাম আযমের জানাজা পড়ান তাঁর চতুর্থ ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী। জানাজার আগে আমান আযমীসহ জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।

আমান আযমী বলেন, ‘গোলাম আযম এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানী। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হবে, এ দেশে যদি দ্বীন (ইসলাম) বিজয়ী হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাবা কর্মজীবনে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে গেছেন। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, তিনি জ্ঞানত কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু করেননি। এর পরও কেউ উনার কথায়, আচরণে ও কর্মকাণ্ডে ব্যথা বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে আপনারা মাফ করে দেবেন। আমি করজোড়ে দেশবাসীর কাছে মাফ চাচ্ছি।’
জানাজায় জামায়াতের নেতাদের মধ্যে এ টি এম মাছুম, তাসনীম আলম, মতিউর রহমান আকন্দ, মুজিবুর রহমান (মঞ্জু), সেলিম উদ্দিন, ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুল জব্বার অংশ নেন। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান ও ঢাকা মহানগরের আমির রফিকুল ইসলাম খানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দেখা যায়নি।
এ ছাড়া ২০-দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ইসলামিক পার্টির সভাপতি আবদুল মোবিন, লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সভাপতি হাফেজ আবদুল মালেক অংশ নিয়েছেন। এর বাইরে সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ, রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইসলামী আন্দোলনের ঢাকা মহানগর সভাপতি এ টি এম হেমায়েত উদ্দীন, খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান হামিদী, মুসলিম লীগ একাংশের সভাপতি নুরুল হক জানাজায় অংশ নেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন শেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়স্ক গোলাম আযম। কারাবিধি অনুযায়ী, মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে পরদিন শুক্রবার সকালে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পর গোলাম আযমের মরদেহ তাঁর মগবাজারের বাসার নিচতলায় একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত লাশবাহী গাড়িতে রাখা হয়। সেখানে শুক্রবার দিনভর ও গতকাল দুপুর পর্যন্ত মরদেহ দর্শনার্থীদের দেখানো হয়।
গোলাম আযমের ছয় ছেলের মধ্যে পাঁচজনই যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। তাঁদের দেশে ফেরার জন্য এক দিন অপেক্ষা করা হয় বলে পরিবার থেকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পাঁচ ছেলের কাউকেই গতকাল জানাজায় দেখা যায়নি। অবশ্য জামায়াতের একাধিক নেতা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযমের তিন ছেলে দেশে আসতে চেয়েছিলেন। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন তাঁদের ভিসা দেয়নি। তাঁরা সবাই যুক্তরাজ্যের নাগরিক।
একাধিক সংগঠন বায়তুল মোকাররমে গোলাম আযমের জানাজা প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়ায় গতকাল পুলিশ পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশ, দৈনিক বাংলা এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ গেটে পুলিশের একাধিক সাঁজোয়া যানও প্রস্তুত রাখা হয়।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ২৫ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ছিল র্যাবও।
এর মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে ফুটওভারব্রিজের নিচে পরপর পাঁচটি ও মসজিদের পূর্বদিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সামনে চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়।
বিকেল পাঁচটার দিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মহাম্মদ আশরাফ-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, আটক একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছিলেন, তাঁর অপরাধ ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য, কিন্তু বয়স বিবেচনা করে তাঁকে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া হয়। সেই সাজা ভোগরত অবস্থায় মারা যান তিনি।