গ্যাস–সংকটে চুলা বন্ধ

প্রতিবছরই শীতে ঢাকায় তিতাসের লাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের কমবেশি সমস্যা হয়। এ বছর এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। গত দু-তিন বছরে কখনো সমস্যা হয়নি, এমন এলাকাতেও দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট। কোনো কোনো এলাকায় সারা দিন রান্নার চুলাই জ্বলছে না। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওই সব এলাকার বাসিন্দারা।

ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। শীতে সরবরাহ লাইনে সমস্যার পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে।

গ্যাসের সংকটে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকার নীলু মমতাজের। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় সাত বছর ধরে পরিবারসহ এ এলাকায় থাকেন। প্রতিবছরই নভেম্বরের শেষ দিকে গ্যাসের সমস্যা শুরু হতো। এ বছরও তাই হয়েছে। কিন্তু দেড় সপ্তাহ ধরে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একদমই গ্যাস থাকে না। ফলে সারা দিনের খাবার রান্না করতে হয় গভীর রাতে অথবা ভোরে উঠে।

আবার গত সাড়ে তিন বছরে কখনো গ্যাসের সমস্যা দেখেননি ধানমন্ডি ৭/এ–এর বাসিন্দা দীপিকা রহমান। কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে এখানেও সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকে। এক পাতিল পানি গরম করতেও আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।

সংকট আরও তীব্র গুলশান ৯০ নম্বর সড়কের বাড়িগুলোতে। এ সড়কের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, গত এক বছর থেকে গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। প্রথম ছয় মাস সকাল ১০টায় গ্যাস চলে যেত, আসত দুপুরে। এরপর সকাল আটটায় গ্যাস চলে যাওয়া শুরু হয়, আসতে থাকে বেলা দুইটার দিকে। এখনো সকাল আটটায় গ্যাস চলে যায়। কিন্তু সারা দিন আর গ্যাস থাকে না, আসে সন্ধ্যায়।

এ তিন এলাকা ছাড়াও রাজধানীর জিগাতলা, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, সেন্ট্রাল রোড, মোহাম্মদপুরের কাটাসুর, আদাবর ১০ নম্বর, মগবাজারের মধুবাগ, মিরপুর ১৩, আজিমপুরের একাংশ, যাত্রাবাড়ীর রসুলপুর, উত্তরার ৩ ও ১০ নম্বর সেক্টর এবং তুরাগের হরিরামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস–সংকটের তথ্য পাওয়া গেছে।

কাটাসুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের বাসিন্দা নিপুল ম্রং বলেন, সকাল ৯টায় তাঁর কর্মস্থলে যেতে হয়। অন্য সময় সকাল ৮টার দিকে ভাত চুলায় বসাতেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ থেকে ভোর সোয়া ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়। এরপর সারা দিন আর গ্যাসের দেখা নেই। গ্যাস আসে রাত সাড়ে ৯টার দিকে।

হঠাৎ গ্যাসের এমন সংকট সম্পর্কে জানতে দায়িত্বশীল কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতে সরবরাহ লাইনে একধরনের ‘আর্দ্রতা’ জমে। এতে গ্যাসের চাপ একটু কমে যায়। ফলে চুলাতেও গ্যাসের চাপ কমে। কিন্তু এখন যে সংকট চলছে, তার মূলে রয়েছে গ্যাসের জোগানে ঘাটতি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বড় একটি অংশ আসে দেশে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। বাকি অংশের জোগান দেওয়া হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মাধ্যমে।

চাহিদা মেটাতে দেশের খনিগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্য নির্ধারিত আছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট (প্রতিদিন) এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে আসার কথা আরও এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গত নভেম্বরেও দুই উৎস থেকে প্রায় ৩ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন এটি ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো নেমে এসেছে। ফলে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে।

খোলাবাজারে (স্পট মার্কেট) গ্যাসের দাম বৃদ্ধিও জোগান কমার কারণ বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এই সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কাতার ও বাহরাইন থেকে এলএনজি আমদানির জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে। তবে সরবরাহ বাড়াতে গত সেপ্টেম্বর মাসে খোলাবাজার থেকে দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে অনুযায়ী, অক্টোবর-নভেম্বরে দুবার ওই পরিমাণ এলএনজি কেনাও হয়। কিন্তু এখন খোলাবাজারে গ্যাসের দাম (অক্টোবর-নভেম্বরের তুলনায়) প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে খোলাবাজার থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ রয়েছে। এরও প্রভাব রয়েছে চলমান গ্যাস–সংকটে।

কবে নাগাদ এ সংকট কাটবে, জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ্‌ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলএনজির সরবরাহের সমস্যার কারণে এ সংকট হয়েছিল। কাল (আজ শনিবার) থেকে আর এ সমস্যা থাকবে না। কাল থেকে আমরা এলএনজি পাব।’