ছাদেই জমি, ছাদেই চাষ, ছাদচাষিদের বারো মাস

শাহিনুর আক্তার ছাদেই ফলাচ্ছেন নানা জাতের সবজি, ফল। আছে দেশি–বিদেশি ফুল। ৩০ প্রজাতির বেশি গাছ দিয়ে তিনি ছাদকৃষি করেছেন। গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শাহিনুর আক্তার বাজারের লেবু কিনে খান না। তাঁর লেবুগাছটি ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে। এ বছর পেয়ারা কিনতে হয়নি তাঁকে। পেঁপেগাছটির প্রায় সারা শরীর আঁকড়ে ফল ধরেছে।

ঢাকায় মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাহিনুরের ২ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ছাদটি এখন ছোটখাটো খেত অথবা বলতে পারেন নয়া জমানার শূন্যোদ্যান। মৌসুমি ফল, শাকসবজি হয়। ফোটে নানান জাতের দেশি ফুল আর বিদেশি অর্কিড।

সুজলা–সুফলা ছাদ ঘুরে দেখিয়ে কৃষক শাহিনুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামে বড় হয়েছি। ছোট থেকেই গাছের প্রতি টান ছিল। আমার সঙ্গে গাছ থাকতেই হবে। গাছের সঙ্গে আমার সময় ভালো কাটে।’

শাহিনুরের খেতে ৩০ প্রজাতিরও বেশি গাছ রয়েছে। চালকুমড়া, বেগুন, পুঁইশাক, লাউ, ধুন্দল ও পেঁপে নিয়মিত হয়। আছে লেবু, পেয়ারা, জাম্বুরা, আম, ড্রাগন ফল, সফেদা, মাল্টা, করমচা, জামরুল। বছরে পাঁচ কেজি জামরুল ধরে তাঁর গাছে।

রাজধানীতে জমি নেই, কিন্তু ছাদ আছে লাখ লাখ। উদ্যানবিদ ও কৃষিবিদেরা বলছেন, এখানে ছাদকৃষির সম্ভাবনা অনেক। টাটকা শাকসবজি-ফল, শোভা আর নির্মল বাতাসের লোভে এতে মানুষের আগ্রহও বাড়ছে।

করোনাকালে আগ্রহটা বেড়েছে। পরিবেশবান্ধব সংগঠন গ্রিন সেভার্স ছাদকৃষি ও বাগানের বিকাশে কাজ করে। এ সময় সংগঠনটির ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পাতায় ছাদে আবাদের বিষয়ে প্রশ্ন আসা বেড়েছে। অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বাগানবাড়িও চাহিদা বাড়ার হিসাব দিচ্ছে।

শাহিনুর যে ভবনে থাকেন, সেটির আরও দুটি ফ্ল্যাটের মালিক এখন ছাদে বাগান করছেন। পাশের ছাদটি সবুজ হয়েছে গত ছয় মাসে। চারদিকে তাকিয়ে আশপাশের অন্য ছাদগুলোতেও প্রচুর গাছ দেখা যায়।

রাজধানীতে অবশ্য পাঁচ-ছয় বছর ধরেই ছাদকৃষির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সরকারি হিসাবে গত বছর পর্যন্ত নগরে আবাদি ছাদের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭৭৫। আর হাল নাগাদ গ্রিন সেভার্স ৬ হাজারের বেশি ছাদকৃষির সঙ্গে কাজ করেছে।

মোহসিনা হক ও তাঁর স্বামী চিকিৎসক খন্দকার হামিদুল হক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ছাদ কৃষি শুরু করেছেন। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে।
ছবি: সাইফুল ইসলাম

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক’ একটি দিশারি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে শেষ হবে।

প্রকল্পের পরিচালক তাহেরুল ইসলাম বললেন, আগ্রহী নাগরিকেরা কৃষি অধিদপ্তরের সহায়তা নিতে পারেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পরিবেশকে ভালো রাখা দরকার এবং নগর কৃষি নিয়ে সরকার ভাবছে।’

ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ছাদকৃষিসহ গাছের বিষয়ে নানান পরামর্শ দিয়ে থাকে গ্রিন সেভার্স। সংগঠনটির গাছের ডাক্তার, ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক এবং গাছের হাসপাতালও আছে। এ সংগঠন কাজ শুরু করেছিল ২০০৯-১০ সালে।

প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৩–১৪ সাল থেকে মানুষের মধ্যে ছাদবাগানের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ছাদকৃষি এখন মানুষের আড্ডারও বিষয়।’ ফেসবুকে বেশ কিছু গ্রুপ গড়ে উঠেছে। সদস্যরা নিজেদের বাগানের ছবি তুলে শেয়ার করেন। অন্যকে উৎসাহিত করেন।

কোভিডের কালে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তা নিয়ে গত জুলাই মাসে ছাদকৃষি শুরু করেছেন ধানমন্ডির বাসিন্দা মোহসিনা হক। বাড়িটি তাঁর নিজের। ছাদে লেবু, আম, মাল্টা, ডুমুর, আমড়া, পেয়ারা ও কমলা লাগিয়েছেন। চিচিঙ্গা, লাউ, পুঁইশাক, করলাসহ সবজি ফলে। আছে নানান জাতের ফুল।

মোহসিনা ও তাঁর স্বামী চিকিৎসক খন্দকার হামিদুল হক কৃষি অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছিলেন। মাটি, আটটি টব, আটটি ড্রাম, কিছু সার এবং গাছ বাড়িতে পৌঁছে যায়। একজন কৃষি কর্মকর্তা এসে তদারকি করে যান। মাঝেমধ্যেই ফোন করে খোঁজখবর নেন।

মোহসিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে বাসায় থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনে হলো, বাগান করলে কেমন হয়? ছাদ তো আছেই।’

ছাদে আবাদ করতে গিয়ে পরিবারটি অনেক নতুন আনন্দের খোঁজ পেয়েছে। সবাই মিলে গাছের যত্ন নেন। বিকেলে চায়ের আড্ডা জমে ওঠে ছাদে।

বাগানবাড়ি প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে অর্ডার নিয়ে মাটি, সার, গাছ, টবসহ ছাদে বাগান আর কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে। দুই বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলছেন, করোনাকালে বিক্রি তিন গুণ বেড়েছে। তিনি জানান, এযাবৎ তাঁরা ছাদে আবাদ, বারান্দায় বাগান, গাছ দিয়ে আঙিনা-ভবনের পরিবেশ সাজানোর মতো ৪৬৫টি কাজে সেবা জুগিয়েছেন। প্রায় অর্ধেকই ছিল ছাদকৃষি-সংক্রান্ত কাজ।

ছাদের সুরক্ষা?

মোহাম্মদপুরের যে বাসায় শাহিনুর আক্তার থাকেন, তাঁর মালিকানা তিনিসহ চারজনের। তিনি বাগান শুরু করেছিলেন ২০১২ সালে। দুই বছর হলো পুরোদমে তাঁর ছাদকৃষি চলছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি নিজেই ছাদের দেখভাল করেন।

জালোওয়াশান আখতার খান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকেন। বছরখানেক আগে ছাদে বেগুন, টমেটো, পুঁইশাক আর লাউ লাগিয়েছিলেন। কিছুদিন পর বাড়িওয়ালা বললেন, এসব করা যাবে না, ছাদ নষ্ট হবে।

জালোওয়াশান বাধ্য হয়ে সব গাছ বারান্দায় নামালেন। তারপর একবার ছাদে মাচা বেঁধে তাতে করলা, চালকুমড়া আর ধুন্দলের লতা তুলেছিলেন। বাড়িওয়ালা এসে সেগুলোও সরাতে বলেন। তৈরি গাছ বারান্দায় নিয়ে দড়িতে বাইয়েছিলেন জালোওয়াশান। বাঁচেনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন, ছাদে পানি জমতে না দিলে চাষাবাদ বা বাগান ছাদের ক্ষতি করবে না। পানিনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর বৃষ্টিতে বা রোদে ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এমনিতেও সমস্যা হয় না।

এই স্থপতি বললেন, নব্বইয়ের দশকের পরে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনেক বেশি সতর্ক হয়েছে। ছাদ নির্মাণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। তা মানলে ছাদগুলো ছাদকৃষি বা বাগান করার উপযোগী মজবুত হয়।

গ্রিন সেভার্স যে ৬ হাজার গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করেছে, কেউ ছাদ নষ্ট হওয়ার কথা বলেনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আহসান রনি বলেন, গাছ থাকলে বরং ছাদের উপকার হয়। সরাসরি সূর্যের আলো ও বৃষ্টির পানি পড়ে না। আর টবের মাটির কারণে তেমন ভার পড়ে না।

কৃষি এবং ছাদে চাষাবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চ্যানেল আইয়ের পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ। তিনি বলছেন, কেউ কেউ ডেঙ্গু মশা হওয়ার ভয় করেন। সেটা ভুল। অব্যবহৃত ছাদে বরং পানি জমে থাকে। খেত-বাগান থাকলে নিয়মিত নজরদারি আর পরিচ্ছন্নতার সুযোগ বাড়ে।

ছাদবাগান থেকে ছাদকৃষি

শাইখ সিরাজ বলছেন, ১৯৮০ সাল থেকে ছাদে কাজি পেয়ারার গাছ লাগানো দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন। তখন শহুরে মানুষ শখে ছাদে হয়তো ফুলগাছ লাগাত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘তখন এটাকে ছাদবাগান বলতাম। এখন এটাকে ছাদকৃষি বলছি।’

মানুষ টাটকা এবং রাসায়নিকমুক্ত সবজি-ফল চায়। ছাদে লেবু-মরিচগাছ লাগানো শুরু হলো। বাগান হয়ে উঠল খেত। এখন সরকার আর সিটি করপোরেশন আগ্রহ দেখাচ্ছে। শাইখ সিরাজ বলেন, সরকার সহায়ক নীতি করে এটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ছাদকৃষি-সংক্রান্ত প্রকল্পটির পরিচালক তাহেরুল ইসলাম বলছেন, ‘সবুজের সঙ্গে থাকলে মন ভালো থাকে।’ ছাদকৃষকদের কারিগরি সহায়তা দিলেই হয়। ঢাকায় ১৪ লাখের মতো ছাদ আছে। এর কিছু অংশও কাজে লাগলে মানুষ ও পরিবেশ উপকৃত হবে।

নগরীর দুই সিটি করপোরেশন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রচারণা করছে, ছাদে বাগান করলে ১০ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করা হবে। গত মাসে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এর একটি নীতিমালা করা হবে।

মেয়র আরও বলেছেন, পরিবেশ আর কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীদের নিয়ে একটি কমিটি করা হবে। যাঁরা ছাদবাগান করবেন, তাঁদের এই কমিটি সনদ দেবে। দুই সিটি করপোরেশনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কাজের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ছাদকৃষি করবেন?

রাজধানীর অনেক রাস্তার ধারে গাছ লাগানোর কেজো আর শৌখিন পাত্র পাওয়া যায়। অনলাইনেও গাছ আর নানা ধরনের সরঞ্জাম প্রচুর বিক্রি হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে নার্সারি।

আগারগাঁও এলাকায় শাহ আলমের অরণ্য নার্সারি। তিনি ২২ বছর ধরে এই ব্যবসায় আছেন। বললেন, ৫ থেকে ৭ বছর ধরে মানুষ ছাদবাগানের জন্য গাছে নিচ্ছে বেশি। তিনি নিজেও মৌসুমি সবজি আর বড় ড্রাম বা পাত্রে হওয়া ফলের গাছ বেশি রাখছেন।

ছাদকৃষক হওয়ার এখনই সময়! ছাদে সবজিটা ভালো হয়, দ্রুত ফলন হয়। মানুষ তাই সবজি চাষে ঝুঁকছেন বেশি। কয়েক বছরেই ফলন হয়, এমন ফলের গাছ অনেক আছে। ছাদকৃষকের জন্য তা সুখবর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে এর ওয়েবসাইটে। প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান আর বিভিন্ন ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

ছাদকৃষির জন্য গ্রিন সেভার্সের কিছু পরামর্শ আছে। পর্যাপ্ত রোদ পায়, এমন জায়গা বাছতে হবে। পানির সরবরাহ ভালো থাকা চাই।

টব বা ড্রাম মেঝে থেকে সামান্য উঁচুতে বসাতে হবে। ঘেঁষাঘেঁষি বসাবেন না। প্লাস্টিকের ড্রামে প্রচুর গ্যাস হয়। মোটা টিনের ড্রাম ভালো করে রং করে নিন। সবজি বুনবেন টুকরো খেত বা বেড তৈরি করে।

ফলসহ গাছ কিনবেন না। নার্সারিতে ফলন দেওয়া গাছের বয়স বেশি থাকে। বাড়িতে নিয়ে এলে বেশি দিন আর ফল দেবে না।

সচরাচর তিন বছর বয়স থেকে একটি গাছের ফলন ভালো হয়। ফল দেয় সাত থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত। সুতরাং একটু ছোট গাছ কিনুন।

গাছে বেশি পানি দেবেন না। পানির পরিমাণ এমন হবে, যেন ৩০ মিনিটের মধ্যে মাটি তা শুষে নিতে পারে।

মাটির যত্নে বিশেষ মনোযোগ চাই। দরকারমতো সার দিতে হবে। নিয়মিত নিড়ানি দিতে হবে। শিকড় পর্যন্ত খাবার পৌঁছাতে মাটি আলগা করে দিতে হয়।

পোকা বা রোগে আক্রান্ত পাতা বা ফল ফেলে দিতে হবে। তাহলে সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে না। বিষ না দেওয়া ভালো।

মোহাম্মদপুরের ছাদচাষি শাহিনুর ইউটিউব, অনলাইন ঘেঁটে পরামর্শ নেন। তিনি বাজারের সার, কীটনাশক দেন না। সবজি, ফলের খোসা ও ডিমের খোলা থেকে সার তৈরি করেন। নিম, অ্যালোভেরা দিয়ে প্রতিষেধক বানান। প্রয়োজনে গ্রিন সেভার্স থেকে গাছের ডাক্তার ডাকেন।

ইট-কংক্রিটের এই ঘনবসতি শহরে গরম বাড়ছে। করোনা–বিরতির পর বাতাসের দূষণ লাফিয়ে ফিরে আসছে। ছাদে খেত থাকলে তার নিচের তলা অনেকটা শীতল থাকে। সবুজের ছায়া আর কিছুটা নির্মল বাতাস হয়।

এ ছাড়া ছাদে আবাদ থাকলে পাখি আসে, বললেন শাইখ সিরাজ। এই শহর থেকে পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে। ছাদগুলো সবুজ হলে তারাও হয়তো ফিরবে।