ছুটি পেয়েই কমলাপুরে ছুট

১০ দিনের ছুটি। তাই ঘরে ফিরতে কমলাপুর স্টেশনে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো
১০ দিনের ছুটি। তাই ঘরে ফিরতে কমলাপুর স্টেশনে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো

পরিবারের তিন সদস্যের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাচ্ছেন তরিকুল ইসলাম। সঙ্গে স্ত্রী ও মেয়ে। তাঁর মুখে একটা মাস্ক থাকলেও স্ত্রী ও মেয়ের সুরক্ষায় মুখে কোনো মাস্ক ছিল না। একমাত্র শ্যালিকার বিয়েতে যোগ দিতে করোনা–আতঙ্কের মধ্যেও দীর্ঘ যাত্রায় রওনা হলেন এই পরিবারের সদস্যরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তরিকুল বললেন, ‘কী করব, আগে থেকে বিয়ের তারিখ ঠিক করা ছিল। ঝুঁকি আছে জানি, সতর্কও আছি। এরপরও যদি ভাইরাস ধরে কিছু তো করার নেই। মরতে তো একদিন হবেই।’

আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। পরিবার নিয়ে তিনি তখন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। এ সময় স্টেশন প্ল্যাটফর্মে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কেউ জরুরি প্রয়োজনে বাড়ি ফিরছেন, কেউবা ঘুরতেও যাচ্ছেন। দুদিন ধরে ট্রেনের টিকিট বিক্রিও বেশ বেড়েছে।

করোনাভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে সোমবার সরকারি অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এরপর রাত থেকেই নগরের বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে এবং রেলস্টেশনে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। ছুটি ঘোষণার সময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছিল সরকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

কমলাপুর স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান, আজ কমলাপুর স্টেশন থেকে ৩১ হাজার ৯৬০টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত ১১টি আন্তনগর ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। অবশ্য বেলা দুইটার দিকে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, সন্ধ্যা থেকে আর কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে না। অর্থাৎ নতুন করে কোনো ট্রেন ছাড়বে না। যেগুলো পথে আছে, সেগুলো গন্তব্যে যাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমলাপুর স্টেশনের ১২ নম্বর কাউন্টারে বসা রেলকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাত্রীর এত চাপ, আসনবিহীন টিকিটও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে।’

কমলাপুর স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করে শরীরের তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে। রেলওয়ের পাঁচজনের একটি দল সকাল থেকে এ কাজ করছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, স্টেশন ছাড়ার আগে প্রত্যেকটি ট্রেনে জীবাণুনাশক দেওয়া হচ্ছে। তবে বেলা সোয়া একটায় স্টেশন ছেড়ে যাওয়া বনলতা এক্সপ্রেসের যাত্রী ফয়সাল আহমেদ প্রথম আলোকে জানালেন, ওই ট্রেনে যাত্রার পূর্বে জীবাণুনাশক দেওয়া হয়নি। তিনি স্টেশনে প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলেন। এ সময়ে তিনি কোনো ট্রেনেই জীবাণুনাশক স্প্রে করতে দেখেননি। ফয়সাল আহমেদের মুখে অবশ্য মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছিল। যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিস ছুটি দিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় থেকে কী করব। পরিবার তো রাজশাহীতে। বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারান্টাইনে থাকব।’

১০ দিনের ছুটি। তাই ঘরে ফিরতে কমলাপুর স্টেশনে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো
১০ দিনের ছুটি। তাই ঘরে ফিরতে কমলাপুর স্টেশনে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের নান্দাইলে নানাবাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছেন এক কলেজ শিক্ষার্থী। নাম–পরিচয় জানতে চাইলে লজ্জা পেয়ে বললেন না। তাঁর বাসা পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এখানেই মা–বাবা থাকেন। পড়ছেন কবি নজরুল ইসলাম কলেজে। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না। আমার মুখে তো মাস্ক আছে। আমি সচেতন আছি। কলেজ ছুটি ক্লাস নেই, তাই ঘুরতে বের হয়েছি।’

ট্রেনের টিকিট না পেয়ে স্টেশন কাউন্টারের এদিক–সেদিক ঘুরছিলেন সরকারি তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী সামিউল আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘টিকিট পাইনি। আসনবিহীন টিকিট কাটতে হবে। দাঁড়ায়ে এত পথ যাব না। তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কিন্তু বাড়ি যেতেই হবে। ছুটি আছে, এমনিতেই বাড়ি যাচ্ছি। জরুরি প্রয়োজন না।’

কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হামিদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল আর আজ যাত্রীর চাপ বেশি। স্টেশনে ঢুকতেই মানুষের হাত স্যানিটাইজ করা, থার্মাল যন্ত্র দিয়ে তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে। মাইকে সার্বক্ষণিক ঘোষণা আমরা দিচ্ছি। তবে সামাজিক দূরত্ব মানুষ মানছে না। গিজগিজ করছে, গা ঘেঁষে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। মানুষ যদি সচেতন না হয় আমরা আর কি করতে পারি। সরকার বলেছে, জরুরি প্রয়োজনে ছাড়া বের না হতে। অথচ মানুষ ছুটি পেয়েই বাড়ির দিকে ছুটছে। এতে করে করোনাভাইরাসটা তো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষকে এগুলো কে বোঝাবে?’