করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় আতঙ্কে পুরো দেশ যখন স্তব্ধ, তখনই শুরু হয় সরকারি ঝিল ভরাটের কাজ। দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই ভরাটের কাজ শেষ করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়। সম্প্রতি স্থাপনা নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। খিলগাঁওয়ের নতুনবাগ এলাকায় ঝিল ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের এমন অভিযোগ উঠেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক রাওফুল আলম খান ওরফে শুভর বিরুদ্ধে।
যুবলীগের এই নেতা সরকারি যে ঝিল ভরাট করেছেন, ভূমি অধিগ্রহণ সূত্রে এর মালিক সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ষাটের দশকে নতুনবাগের ২ দশমিক ৬৮ একর ঝিলের জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করে। দখল হওয়া ওই জমি উদ্ধারে এখন পর্যন্ত তাঁরা তিন দফায় রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তবে ওই জায়গা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এই জমি উদ্ধার করা হবে।
নতুনবাগ ঝিলের জায়গাটি দেখভাল করছে গণপূর্তের রেলওয়ে ডাইভারশন উপবিভাগ। উপবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই জায়গা যাতে কেউ দখল না করেন, তাই সেখানে সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সাইনবোর্ড ফেলে দেওয়া হয়েছে। গেল বছরের জানুয়ারি মাসে ঝিল ভরাটের প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, দখলদারদের বাধাও দিয়েও দখল ঠেকানো যায়নি। এখন পর্যন্ত সেখানে সরকারের অধিগ্রহণ করা ৩৩ শতাংশ জমি দখল হয়ে গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিলের দক্ষিণ দিকে মাটি ভরাট করার পর সেখানে হাঁটুসমান ইটের দেয়াল তৈরি করে সীমানা দেওয়া হয়েছে। ভরাট করা অংশে একটি ঘর তৈরি হয়েছে। নতুনবাগ এলাকায় ইসমাইলের গলি হয়ে ঝিলের প্রবেশমুখেই গেট নির্মাণ করে ভেতরে প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিনের তৈরি আরও একটি স্থাপনা ভরাট করা জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিলের কিছু অংশ ভরাট করে কয়েক বছর আগেই যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের ক্লাব তৈরি করা হয়েছিল। এসব ক্লাব ভেঙে ঝিলের আরও কিছু অংশ দখলে নিতে মাটি ভরাট করেছেন রাওফুল আলম। ওই জায়গায় স্থানীয় ফজলু নামের এক ব্যক্তির টিনের একটি স্থাপনা ছিল, যা সরকারি জায়গায় নির্মিত ছিল। ওই স্থাপনা সরিয়ে নিতে ফজলুকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন রাওফুল আলম। ঝিল ভরাটের এই কাজে দখলদার রাওফুল আলমকে সহায়তা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাখাওয়াত হোসেন ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হায়দার আলী। সরকারি জমি দখলে নিতে পারলে স্থানীয় কাউন্সিলর শাখাওয়াত হোসেনকে চার কাঠা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হায়দার আলীকে দুই কাঠা জমি উপহার হিসেবে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাওফুল আলম। রাওফুলের সঙ্গে সরকারি জমি দখলে সরকারেরই আরেকটি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রধান কার্যালয়ের মতিঝিলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এম এম আহসান আলম ওরফে সৈকত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
অবশ্য যুবলীগ নেতা রাওফুল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওই জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। ১৯৫৬ সালে তাঁর বাবা ফিরোজ সেখানে ১২১ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। গণপূর্তের সঙ্গে জমির রেকর্ড সংশোধনে এ বিষয়ে একটি মামলা চলছে। এখন পর্যন্ত তিনি ৩৭ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়েছেন।
কাউন্সিলর শাখাওয়াত হোসেনকে চার কাঠা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হায়দার আলীকে দুই কাঠা জমি উপহার দেওয়ার বিষয়ে রাওফুল আলম বলেন, সেখানে আড়াই কাঠার মতো জমি এক ব্যক্তি দখল করে রেখেছেন। কাউন্সিলরকে তিনি বলেছেন, ঝামেলা শেষ করতে পারলে এলাকার মানুষের জন্য একটা মসজিদ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জায়গা দেবেন।
তবে কাউন্সিলর শাখাওয়াত প্রথম আলোকে বলেন, চাইলেই কি তবারকের মতো সরকারি জায়গা দিতে পারবেন। আগে তো তাঁকে জমির মালিকানা পেতে হবে। যেখানে তিনি মালিকানাই পাননি, সেখানে জমি উপহার দেবেন কীভাবে?
হায়দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, দুই কাঠা জমি উপহার দেওয়ার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে রাওফুলের কোনো কথা হয়নি।
গণপূর্ত রেলওয়ে ডাইভারশন উপবিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ এস এম সাখাওয়াত ইসলাম বলেন, সরকারি জমি উদ্ধারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তাঁরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পেয়েছেন। শিগগিরই সেখানে অভিযান চালানো হবে।