টিএসসিতে কাওয়ালি গানের আয়োজন নিয়ে ফেসবুকে যা পাওয়া গেল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে গতকাল বুধবার হামলায় পণ্ড হওয়া কাওয়ালি গানের আয়োজনটি করেছিল শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তবে এ আয়োজনকে ঘিরে এর আগেই ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় আলোচনা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই দ্বিমুখী আলোচনায় যোগদানকারীদের একটি অংশ কাওয়ালিকে অনৈসলামিক উল্লেখ করে এই আয়োজন বর্জনের আহ্বান জানায়। আরেক অংশ এই আয়োজনকে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে বর্ণনা করে। এমন আলোচনা চলার মধ্যেই গতকাল ওই হামলার ঘটনা ঘটে।
আয়োজক শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, কাওয়ালির ওই আয়োজন গতকাল সন্ধ্যায় শুরু হয়ে চলার কথা ছিল রাত ৯টা পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যান্ড ‘সিলসিলা’ ও কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ছিল এই আয়োজন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় টিএসসির সঞ্জীব চত্বরে এ অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এতে আয়োজন পণ্ড হয়ে যায়। হামলার পর ফেসবুকে অনেকেই এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কেউ কেউ আবার সমর্থন করেছেন।
টিএসসিতে কাওয়ালি আয়োজনের আগেই এর বিরোধিতা করে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা মো. আহসান আজিজ ফেসবুকে লেখেন, ‘বাঙালির ভাষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু ধ্বংসের উৎসব আজ। যেখান থেকে বাংলা ভাষার দাবি শুরু, পাকিস্তানের বিপক্ষে কথা বলা শুরু, সেখানেই হবে কাওয়ালি উৎসব! মাদ্রাসার আধুনিকীকরণের সময় হয়তো আর বেশি নেই, তবে আধুনিকতার মাদ্রাসিকরণ ২৫ বছর আগেই শুরু হয়েছে।’
আয়োজনের বিরোধিতা করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘মারকাযুল লুগা’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শায়েখ মহিউদ্দিন ফারুকী লিখেছিলেন, ‘মূর্খ সেলিব্রিটি টাইপের কারও আবেদনে কাওয়ালি দেখে বা শুনে সওয়াব হাসিল করতে যাবেন না। সাধারণ কনসার্ট আর কাওয়ালি একই মুদ্রার দুই পিঠ। শিরক-বেদাতের ছড়াছড়ি ছাড়াও রয়েছে বাদ্যযন্ত্রের বাহারি ব্যবহার। তাই কাওয়ালির অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকেও বিরত থাকুন।’
লেখক শায়খ মীযান হারুন লিখেছিলেন, ‘প্রচলিত কাওয়ালি কিংবা শ্যামাসংগীত নামে যা কিছু বলা বা করা হয়, ইসলামি শরিয়তে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। কাওয়ালি নামে দেশে যা করা হচ্ছে, সেগুলো সমর্থন করার কোনো শরয়ি অনুমোদন কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিকতা নেই।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহপ্রচার ও দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম লেখেন, ‘আমি কাওয়ালি শুনি না, কাওয়ালিকে জায়েজও মনে করি না।
তারপরও টিএসসির কাওয়ালিকে শুভকামনা জানাই। ক্যাম্পাসের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম ও ইসলামসম্পৃক্ত সবকিছুই কার্যত নিষিদ্ধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে টিএসসিতে কোনো না কোনোভাবে (তা বিকৃতরূপে হলেও) ইসলামসম্পৃক্ত যেকোনো কিছুকে ইতিবাচকভাবে দেখার একধরনের তাগিদ অনুভব করি। এই বোধ থেকেই শুভকামনা জানানো।’
ছাত্রলীগের হামলার পর শেখ ফজলুল করীম লেখেন, ‘কাওয়ালি হলো কি হলো না, তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই কাওয়ালিকে ঘিরে যা হলো তা। প্রথমত একে ঘিরে ইসলামপন্থীদের মধ্যে যে বিতর্ক উঠেছে ও সেই বিতর্কে যে ধারার যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ধর্ম-ইতিহাস সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া অতিমাত্রায় দুর্বল বা ভুল বোঝাপড়া নিয়ে তারা চলছে। অন্যদিকে কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদে প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে চলা প্রতিবাদে একজন এই হামলার পেছনে হেফাজতকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। এর মানে, যারা কাওয়ালির মতো একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রু-মিত্র নিয়ে কী ভয়ানক অজ্ঞতা কাজ করছে! দ্বীন রক্ষায় হেফাজতের মতো রক্তের নজরানা দেওয়া একটা ধারাকে সে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। অথবা এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে বিপক্ষ এজেন্ট প্রবেশ করে ফোকাস নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং পেরেছেও।’
মীযান হারুন এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘কাওয়ালির বিরোধিতা করি, কাওয়ালির মঞ্চ ভাঙারও বিরোধিতা করি। কাওয়ালির বিরোধিতার কারণ ইমান। মঞ্চ ভাঙার বিরোধিতার কারণও ইমান।’
এদিকে হামলাকে সমর্থন করেও একাধিক পোস্ট দেখা গেছে ফেসবুকে। মীর সালমান নামের একজন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। নিশ্চয়ই আল্লাহ ফ্যাসিবাদীদের দ্বারাও এই দ্বীনের কল্যাণ করেন।’
আরিফা রহমান (রুমা) নামে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাওয়ালি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। শুনতে বেশ লাগে। সমস্যা হচ্ছে এর আয়োজকদের নিয়ে। আয়োজক কারা ছিল, কেন অনুষ্ঠান পণ্ড হলো—এগুলো সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিন। ইসলামী শাসনতন্ত্র, হিযবুত তাহ্রীর আর ওসব অধিকারের কথা বলাওয়ালারা যে আমাদের নিছক বিনোদন দিতে চায়নি, এটা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন নেই। মদ সেই পুরোনোটাই, বোতলটা নতুন। এই আরকি! নয়া কৌশল।’
কাওয়ালি আয়োজনের বিষয়ে এর অন্যতম উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের ছাত্র আল আমিন রাকিব (তনয়) বলেন, ‘উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী সংগীতধারা হচ্ছে কাওয়ালি। কাওয়ালি গানের রয়েছে এক অনবদ্য শক্তি, যা অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয়, মনকে করে তোলে পবিত্র। ভারত-পাকিস্তানে বহুল পরিচিত এই সংগীতধারা বাংলাদেশের মূলধারায় খুব বেশি পরিচিত নয়। শিল্পের এই পুরোনো ও জনপ্রিয় ধারাকে সামনে তুলে আনতেই আমাদের এই আয়োজন।’
আল আমিন আরও বলেন, ‘টিএসসিতে কাওয়ালি নিয়ে নানা জায়গায় নানা কথা হচ্ছে। কেউ কাওয়ালিকে বলছেন শিরক-বেদাতের আস্তানা। কেউ একে দেখছেন রাজনৈতিক চাল হিসেবে; কেউ আবার ধরে নিয়েছেন ইসলামপন্থীদের উত্থান হিসেবে। এটা আসলে সাধারণ একটা গানের আসর।’