টোলারবাগ-পূর্ব রাজাবাজারের পর লকডাউনে সাফল্য ওয়ারীতেও

রাজধানীর টোলারবাগ ও পূর্ব রাজাবাজারে সফলতার পর ‘রেড জোন’ ওয়ারী লকডাউন করে সংক্রমণ কমানো গেছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, তিন জায়গাতেই সরকারের তৎপরতার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা এ সফলতার মূলে কাজ করেছে। ওয়ারীসহ তিন লকডাউনে নেতৃত্ব দিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
কোরবানির ঈদের আগে অন্তত রাজধানীতে কোনো এলাকায় লকডাউনের সম্ভাবনা কম। তবে ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে পারে। তখন রাজধানীতে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের দরকার আছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। এই তিন জায়গার মডেল ব্যবহার করে ঈদের পরপরই এলাকা নির্ধারণ করা দরকার বলেও মনে করেন তাঁরা।
৪ জুলাই থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারী এলাকায় লকডাউন শুরু হয়। ওই দিন ভোর ছয়টা থেকে ওয়ারীর টিপু সুলতান রোড, যোগীনগর রোড ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক (জয়কালী মন্দির থেকে বলধা গার্ডেন), লারমিনি স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, র্যাংকিন স্ট্রিট ও নবাব স্ট্রিট লকডাউনে শুরু হয়। শেষ হয় গত শুক্রবার রাত ১২টায়। ওয়ারীর এই এলাকা দক্ষিণ সিটির ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে।
আইইডিসিআর সূত্র জানায়, এবার ওয়ারীর লকডাউনের সময় ৩১৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই ৩১৬ জনের মধ্যে ২৮৯ লকডাউন এলাকার। বাকি ২৭ জন ভিন্ন এলাকা থেকে এসে নমুনা দিয়েছিলেন। লকডাউন এলাকার মধ্যে যে ২৮৯ জনের নমুনা নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ৯৫ জনের নমুনা পজিটিভ আসে।
লকডাউন এলাকায় প্রথম সপ্তাহে ১০৫ জন নির্দিষ্ট স্থানে এসে নমুনা দেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে নমুনা দেন ৮০ জন। তৃতীয় সপ্তাহে দেন ১০৪ জন।
আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃতীয় সপ্তাহে গিয়ে আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেস খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছি। প্রথম সপ্তাহে ৪২ জন পজিটিভ হয়েছিল, দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৪ জন এবং তৃতীয় সপ্তাহে ২৯ জন পজিটিভ হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজার জন্যই শনাক্ত বেড়েছে।’
তৃতীয় সপ্তাহে যে ২৯ জন শনাক্ত হয়েছিলেন, তা করা হয়েছে সপ্তাহের প্রথম দিকে। সপ্তাহের শেষ দিকে পজিটিভ হওয়ার সংখ্যা কমে এসেছে।
মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘এখন আমরা দেখছি ওয়ারীতে কেস অনেক কমে গেছে। কোনো দিন নেই, কোনো দিন দুইটা-তিনটা। অথচ ওই এলাকায় প্রচুর কেস ছিল। সেদিক থেকে বলা যায়, ওয়ারীতে ঘরে ঘরে গিয়ে সন্ধান ভালো কাজ করেছে।’
মহামারি বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন হওয়া কোনো এলাকার প্রথম দিকের চেয়ে শেষ দিকের নমুনার হার মেলাতে হবে। তাহলেই সেই এলাকার উন্নতি হচ্ছে কি না, তা বোঝা যাবে।
মহামারি বিশেষজ্ঞ, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউন হওয়া ওয়ারীর প্রথম ১৪ দিনের সঙ্গে শেষ ১৪ দিনের হিসাব মিলিয়ে দেখা গেছে, এখানে সংক্রমণ কমেছে। এর মধ্যে সাত দিন ওভারল্যাপ হিসেবে ধরতে হবে। সংক্রমণ কমে যাওয়ায় রেড থেকে ইয়েলো বা হলুদ জোনে এসেছে ওয়ারী।
আইইডিসিআর সূত্র জানায়, ওয়ারীতে প্রথম সপ্তাহে পজিটিভ ছিল ৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় সপ্তাহে পজিটিভ হওয়ার রেট ছিল ৩০ শতাংশ। তৃতীয় সপ্তাহে ২৮ শতাংশ।
এখন লকডাউন উঠে গেলেও ওয়ারীতে নমুনা সংগ্রহের বুথ আছে। যেসব বাড়িতে রোগী আছেন, সেগুলো যাতে নজরদারিতে থাকে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীতে প্রথম লকডাউন করা হয় ২৩ মার্চ। ওই দিন থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের টোলারবাগ এলাকায়। ২১ ও ২২ মার্চ পরপর দুজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রাজধানীর বেশি সংক্রমিত এলাকার মধ্যে একটি ছিল এই টোলারবাগ। এই তিন হাজার জনসংখ্যার এলাকায় আক্রান্ত ছিলেন ১৭ জন। ১০ এপ্রিলের মধ্যে সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ওয়ারীতে যেমন শেষ সপ্তাহে ঘরে ঘরে গিয়ে কেস খুঁজে বের করা হয়েছে, টোলারবাগেও সেটা করা হয়েছিল। সেখানে স্থানীয় ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মুরাদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল কাজ করে।
মুরাদ হোসেন আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় টোলারবাগে সাফল্য এসেছিল। এখন লকডাউন উঠে যাওয়ার এত দিন পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।’
টোলারবাগে বাড়তি কিছু কাজ করা হয়েছিল। সেগুলো হলো, যাঁরা রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁর উপসর্গ থাকুক আর না থাকুক, তাঁদের পরীক্ষা করা হয়েছিল। বয়স্ক ব্যক্তি, যাঁদের কোমর্বিডিটি আছে, তাঁদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।
মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, সেখানে এমন কাজ করা হয়েছিল যে টোলারবাগের আক্রান্ত ব্যক্তি শরীয়তপুরে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল।
ঢাকা উত্তর সিটির আরেক এলাকা পূর্ব রাজাবাজারে থাকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। একপর্যায়ে এখানে ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জুন মধ্যরাত থেকে এই রেড জোন এলাকায় লকডাউন শুরু হয়। শেষ হয় ৩০ জুন। ওই দিন এলাকায় লকডাউনের ২১ দিন পূর্ণ হয়। আইইডিসিআর এই লকডাউন–ব্যবস্থা দেখভাল করে। আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়। পূর্ব রাজাবাজার উত্তর সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, এ এলাকায় প্রথমে ৩২ জন সংক্রমিত ছিলেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে সব মিলিয়ে ৬০ জন শনাক্ত হন। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই ৪৫ জন সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে আরও ৯ জন সুস্থ হন। বাকি ৬ জন ২১ দিনর মধ্যে সুস্থ না হলেও পরে সুস্থ হয়ে যান।
টোলারবাগ, পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারী—তিন জায়গাতেই আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে স্থানীয় মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওয়ারীতে ৪৯ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এবার ওয়ারীর লকডাউনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরাও যুক্ত ছিলেন।
রাজধানীর তিন জায়গায় সাফল্যের মধ্যে দেশেও করোনা সংক্রমণ কমছে। কিন্তু ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পশুর হাট বসছে। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই যেসব নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ধার ধারছে না কেউ। আবার এর মধ্যে ঈদে অনেক মানুষ বাড়ি যাবে এবং পরে ঢাকায় ফিরবে। এর ফলে ঢাকায় ঈদের পর বড় সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে রাজধানীতে। তখন এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। আর সেখানে সবচেয়ে বেশি জরুরি স্থানীয় মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা।’
তাহলে ঈদের পর কি নতুন করে লকডাউন হবে?
মীরজাদী সেব্রিনা বললেন, কোথাও লকডাউন করা শুধু আইইডিসিআর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তের বিষয় না। এখানে নানামুখী প্রচেষ্টার দরকার। একাধিক মন্ত্রণালয় নিয়োজিত থাকে। এটা সবার সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে জনসম্পৃক্ততা এখন জরুরি।
অধ্যাপক সেব্রিনার সঙ্গে একমত জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি সরকার নিয়োজিত কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য। আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ঈদের পরের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রামাঞ্চলে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার নজির আছে।
গ্রামের মতো ছোট জনসংখ্যার এলাকায় যেটা সম্ভব, সেটা কি রাজধানীতেও কার্যকর হবে?
অধ্যাপক ফয়সাল বলেন, ‘খুবই সম্ভব। তিনটি অঞ্চল আমাদের সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এসব এলাকায় যেভাবে স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হয়েছে, তাতে পুরোপুরি জনগোষ্ঠীকে একাত্ম করা হয়নি। করোনা সংক্রমণ রোধে রাজধানীতে মানুষের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এটা অপিরহার্য।’