ঠিকানায় গিয়ে ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছে না, তাই ওষুধ ছিটানোও হচ্ছে না

ডেঙ্গু মশা।
ফাইল ছবি

বর্ষা মৌসুমে আবারও রাজধানীতে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে আক্রান্ত ব্যক্তির বাসার আশপাশে ওষুধ ছিটানোর কথা রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে ঠিকানা দেওয়া হচ্ছে, তার অনেক জায়গায় গিয়ে রোগীর সন্ধান পাচ্ছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তাতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধও ঠিকমতো ছিটানো হচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত এই সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৬৫ ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৫ জনের ঠিকানায় গিয়ে রোগী পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাঠানো তথ্য অসম্পূর্ণ থাকায় কিছু রোগীর বাসা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

দক্ষিণ সিটির সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবু সাদাত মোহাম্মদ সালেহ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এই সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ (মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর থানা ও খিলগাঁও থানার একাংশ) এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯২। এর মধ্যে ৩৫ জনের ঠিকানায় গিয়ে তাঁরা রোগী পেয়েছেন। বাকিদের ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি।

আবু সাদাত মোহাম্মদ সালেহ জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের বাইরেও বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তথ্য আসছে। ওই সব ঠিকানায় গিয়েও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীর তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল কোথায় হচ্ছে, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কিছু দিন ধরে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে আজ রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১০৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১০২। এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা এটি। চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ১ হাজার ৩০৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম বলেছে, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য এসেছে। সেসব তথ্য পর্যালোচনার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চললেও ২০১৯ সালে ব্যাপকভাবে এ রোগ ছড়ায়। সে সময় সরকারি হিসাবে লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত ও দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর সমালোচনার মুখে দুই বছর ঢাকায় মশকনিধনে ব্যাপক কার্যক্রম চালায় দুই সিটি করপোরেশন। এবার করোনা মহামারির মধ্যে আবার সেই ডেঙ্গু নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী থানা ও খিলগাঁও এবং সূত্রাপুর ও শ্যামপুর থানার কিছু অংশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এসব এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে সিটি করপোরেশন। সংস্থাটি আক্রান্ত রোগীর বাসার চারপাশে ৪০০ গজের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ছিটাচ্ছে।

দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে খিলগাঁও এলাকা ঠিকানা দিয়ে রোগীর নাম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু খিলগাঁও অনেক বড় এলাকা। রোগী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অধিদপ্তর থেকে অনেক রোগীর নাম দেওয়া হয়েছে, হোল্ডিং নম্বর ও মুঠোফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে ওই রোগীকে পাওয়া যায়নি। ফোন নম্বরে কল করা হলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। ফোন ধরে বলা হচ্ছে কুষ্টিয়া থেকে বলছেন, নেত্রকোনা থেকে বলছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা আরও বলেন, আজ রোববার কামরাঙ্গীরচর এলাকার পারভেজ নামের এক রোগীকে খুঁজতে যাওয়ার পর তাঁরা দেখেছেন, ওই হোল্ডিং নম্বরে কোনো রোগী নেই। এ ছাড়া এমনও হয়েছে, চামেলিবাগের এক ঠিকানায় থাকা রোগীর নম্বরে ফোন করার পর বলা হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকাকালে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকায় এসে তাঁর বড় ভাইয়ের চামেলিবাগের বাসায় উঠেছেন। পরে ওই এলাকার একটি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। আজ সন্ধ্যার পর একাধিকবার তাঁকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো ঠিকানার ওপর নির্ভর করছেন না বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এই সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন যে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন, সংস্থার কর্মীরা ওই সব হাসপাতাল থেকে রোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করছেন। এরপর ওই রোগীর বাসা ও আশপাশের এলাকায় ওষুধ ছিটাচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু ভুল তথ্য আসছে। এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, রোগীরা যে তথ্য দিচ্ছেন, সেটাই তাঁরা দিচ্ছেন। রোগী তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ভুল ঠিকানা দিয়ে থাকতে পারেন।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে দুই সিটি করপোরেশন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা ও বাসাবাড়িতে এই মশার লার্ভা পাওয়ায় প্রায় ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মশকনিধন কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে না পারলে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। করোনা মহামারির এই সংকটকালে আরেকটি সংকট যাতে সামনে না আসে, সে জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এ সংকটে কাউকে দোষারোপ না করে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নগরবাসীরও দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন।