ডিএনসিসির অভিযান: ৩৩ ভাগ কর এক মাসে আদায়

গত অর্থবছরে দুটি অঞ্চল থেকে ৯৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা কর এসেছিল।

  • গত অর্থবছরে দুটি অঞ্চল থেকে ১৫৭ কোটি টাকা গৃহকর আদায়ের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা অনাদায়ি থেকে যায়।

  • মাসব্যাপী অভিযানে দুই অঞ্চলে ১ হাজার ১২৮টি করধার্যহীন নতুন ভবন আর ২ হাজার ৮৮০টি সম্প্রসারিত ভবন পেয়েছেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
লোগো

সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে দুটি অঞ্চলে চিরুনি অভিযান চালিয়ে ২৯ কোটি ১০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা গৃহকর আদায় করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত অর্থবছরে দুটি অঞ্চলে ৯৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা কর এসেছিল। সে হিসাবে ১ মাসেই ১ বছরের মোট আদায় করা করের ৩১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর এসেছে।

রাজস্ব শাখার কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে দুটি অঞ্চল থেকে ১৫৭ কোটি টাকা গৃহকর আদায়ের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা অনাদায়ি থেকে যায়।

গৃহকর আদায়ের পরিধি বাড়ানো, রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং কর প্রদানে জনসাধারণকে উৎসাহ দিতেই প্রাথমিকভাবে অঞ্চল-২ ও ৫-এ চিরুনি অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। ফলাফল হিসেবে মাসব্যাপী অভিযানে দুই অঞ্চলে ১ হাজার ১২৮টি করধার্যহীন নতুন ভবন আর ২ হাজার ৮৮০টি সম্প্রসারিত ভবন পেয়েছেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা। নতুন চিহ্নিত ভবনগুলো করের আওতায় এলে কর আদায়ের পরিধি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

চিরুনি অভিযানের প্রাপ্তি

সেপ্টেম্বরে অঞ্চল-২ থেকে ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা গৃহকর এসেছে। গত অর্থবছরে এই অঞ্চলে ২৪ কোটি ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা আদায় হয়েছিল। এক মাসে যে কর এসেছে, সেটা এক অর্থবছরের এক–তৃতীয়াংশের বেশি। আর অঞ্চল-৫-এ গত মাসে ২০ কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। গত বছর এ অঞ্চলে ৬৯ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা কর এসেছিল।

অঞ্চল-২-এ ৩৭ হাজার ৭৪৮টি হোল্ডিং থেকে ৪২ কোটি টাকা আর অঞ্চল-৫-এ ৫৬ হাজার ৬২৩টি হোল্ডিং থেকে ১১৫ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল।

রাজস্বে জনবলসংকট

ডিএনসিসির খোদ রাজস্ব বিভাগের অনেক কর্মকর্তাই বলছেন, রাজস্বে জনবলসংকটে অভিযানের প্রাপ্তিটা সাময়িক হতে পারে। কারণ, রাজস্ব শাখায় প্রয়োজনীয় জনবলের অর্ধেকও নেই। শতভাগ কর আদায়ের জন্য প্রয়োজন শতভাগ জনবলের, তা না হলে কর আগের মতোই অনাদায়ি থেকে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করপোরেশনের একটি অঞ্চলে উপকর কর্মকর্তার সাতটি পদ, রাজস্ব পর্যবেক্ষকের (সুপারভাইজার) ১২টি পদ এবং লাইসেন্স সুপারভাইজারের চারটি পদ রয়েছে। কিন্তু যে দুই অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, ওই দুই অঞ্চল মিলিয়ে উপকর কর্মকর্তা রয়েছেন ৫ জন, রাজস্ব সুপারভাইজার ১০ জন এবং লাইসেন্স সুপারভাইজার রয়েছেন চারজন, যেখানে একটি অঞ্চলেই উপকর কর্মকর্তা ও রাজস্ব সুপারভাইজার পদে এর চেয়ে বেশি কর্মীর প্রয়োজন।

অভিযানে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলররা ছিলেন। তবে অন্য বিভাগের কাউকে অভিযানে সম্পৃক্ত করলে ভালো হতো।
আবদুল হামিদ মিয়া, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, ডিএনসিসি

রিবেটের মাসে গ্রাহক ভোগান্তি

নিয়ম অনুযায়ী জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই তিন মাস কর ছাড়ের (ট্যাক্স রিবেট) মাস। সম্প্রতি কর ছাড়ে আরও এক মাস (অক্টোবর) বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ ছাড়ের নির্ধারিত মাসে কর পরিশোধ করলে গ্রাহক ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরে কর পরিশোধের আশায় আঞ্চলিক কার্যালয়ে এসে গ্রাহকেরা ভোগান্তির কবলে পড়েন। কারণ, কর্মকর্তারা ছিলেন চিরুনি অভিযানে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারের আঞ্চলিক কার্যালয়ে মোহাম্মদপুরের নূরজাহান সড়কের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন জানান, কর দিতে পরপর দুই দিন তিনি কারওয়ান বাজারে আসছেন। কিন্তু কাউকে পাচ্ছেন না।

সপ্তাহে তিন দিন চিরুনি অভিযান করার কথা থাকলেও সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ দিনের ২৬ দিনই চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেন অঞ্চল-৫-এর কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে উপকর কর্মকর্তা মো. শাহীনুর ইসলাম দেওয়ান জানান, ৯ জন উপকর কর্মকর্তা মিলে অভিযান পরিচালনা করেছেন। একেকজন সপ্তাহে তিন দিন করে অভিযানে গেছেন।

অভিযানে শুধু রাজস্বের লোকজন

প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব (গৃহ, বিজ্ঞাপন কর ও ট্রেড লাইসেন্স ফি) আদায় না হওয়ায় করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের
বিরুদ্ধে ঘুষ বা নগদ অর্থ নেওয়ার বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। চিরুনি অভিযানে সংস্থাটির অন্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত না করায় অসংগতির বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে কর আদায়ের ব্যবস্থাকে নষ্ট করে কর ফাঁকি দেওয়ায় লোকজন বেঁচে যাচ্ছেন। তাই অভিযানে অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করলে অসংগতি ও দুর্নীতির চিত্র উঠে আসত।

ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া জানান, অভিযানে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলররা ছিলেন। তবে অন্য বিভাগের কাউকে অভিযানে সম্পৃক্ত করলে ভালো হতো। তিনি বলেন, অভিযানে কর আদায়-অনাদায়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে গ্রাহক ও কর আদায়ের পরিধি দুটিই বেড়েছে।

রিবেটের মাসে অভিযানের কারণে গ্রাহকদের ভোগান্তি হয়েছে, এ অভিযোগ স্বীকার করে হামিদ মিয়া বলেন, ‘গ্রাহকদের ভোগান্তির অভিযোগ শতভাগ ঠিক। কিন্তু আমাদের জনবল কম।’

চিরুনি অভিযান নিয়ে গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী মহসিন আলী বলেন, জনগণের কর দেওয়া উচিত, সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায় করা উচিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কর আদায়ে আগ্রহী নন। এতে অনেকের স্বার্থ জড়িত।

করোনায় অভিযানের বিষয়ে মহসিন প্রথম আলো বলেন, সরকার বিভিন্নভাবে ছাড় দিচ্ছে, সহায়তা করছে। তবে কর আদায়ের আগে গ্রাহকের সন্তুষ্টি তৈরি যেমন রাস্তাঘাট মেরামত, জলাবদ্ধতার সমাধান, পানিনিষ্কাশনের সমস্যা সমাধান করে কর চাইলে গ্রাহকেরা কর প্রদানে আগ্রহী হবেন।