ডুববে ঢাকা, দেখবে ওয়াসা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
• নালা পুরোপুরি পরিষ্কার করা হয়নি, পুনঃখনন হয়নি কোনো খাল
• পানিনিষ্কাশনের দুই প্রকল্প প্রত্যাহার
• মন্ত্রণালয়, ওয়াসা বরাদ্দ বাড়ায়নি


গত বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে প্রায় প্রতিদিন রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকায় অস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী বর্ষায় আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। সেই বর্ষার আর দুই মাস বাকি। কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির কোনো কার্যক্রমই শুরু করা হয়নি এখনো।

জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা এখন পর্যন্ত কোনো নালা পুরোপুরি পরিষ্কার করেনি, পুনঃখনন করেনি কোনো খাল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেছেন, এ বছর প্রকৃতিই ভরসা। বৃষ্টি কম হলে রক্ষা; বেশি হলে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ পাবে। তখন ডুবন্ত ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ১৩৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তারা কোনো কাজ করতে পারছে না।

প্রতিবছর মে মাস থেকে শুরু হয় বর্ষা। আর ওয়াসার নালা ও খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের (রক্ষণাবেক্ষণ) কাজ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে। রক্ষণাবেক্ষণে যে ব্যয় হয়, তার একটি অংশ আসে ওয়াসার নিজস্ব বাজেট থেকে; বাকি অংশ দেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, গত বর্ষার আগে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ওয়াসার বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি টাকা ও মন্ত্রণালয় দিয়েছিল সাড়ে ৫ কোটি টাকা। গত বছর বর্ষায় ব্যাপক জনভোগান্তির পরও এই খাতে এক টাকাও বরাদ্দ বাড়েনি। ওয়াসা লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গত বছরের সমান বরাদ্দই রেখেছে এ খাতে। তারা মন্ত্রণালয়ের কাছে বাড়তি টাকা চেয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তারা তা পায়নি। এর মধ্যে পানিনিষ্কাশন-সংক্রান্ত ওয়াসার নেওয়া দুটি প্রকল্প গত জানুয়ারি মাসে একনেক থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

গতবার জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’

ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতায় ৩৬০ কিলোমিটার পানিনিষ্কাশন নালা, ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও মোট ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল রয়েছে। এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দুটি সার্কেল ও একটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ড্রেনেজ (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) সার্কেল, ড্রেনেজ গবেষণা ও উন্নয়ন সার্কেল এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (ড্রেনেজ) বিভাগ। ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ড্রেনেজ (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) সার্কেলে ৮৭ জন, ড্রেনেজ গবেষণা ও উন্নয়ন সার্কেলে ৩৪ জন এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (ড্রেনেজ) বিভাগে ১২ জন কর্মরত আছেন।

পুরোনো লাইনগুলো দেখভালের দায়িত্ব পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেলের। এই সার্কেলে মোট সাড়ে ১৬ কোটি টাকা (ওয়াসা ও মন্ত্রণালয়) বরাদ্দের মধ্যে চার কোটি টাকা ধরা হয়েছে ওয়াসার চারটি পাম্প স্টেশন ও ১৬টি অস্থায়ী পাম্প পরিচালন ব্যয় হিসেবে। ফলে পানি নিষ্কাশন নালা, বক্স কালভার্ট ও খালের জন্য থাকছে সাড়ে ১২ কোটি টাকা। এই টাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে ১০ শতাংশ ঠিকাদারের লাভ, ৬ থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ফলে রক্ষণাবেক্ষণে প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ থাকবে ১০ কোটি টাকার মতো। এই সার্কেলের কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়াসার ৩৬০ কিলোমিটার নালাতে ম্যানহোলই আছে প্রায় ১৩ হাজার। প্রতিবছর এসব ম্যানহোলের কাভার ও স্লাব মেরামত করতেই দুই থেকে তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়। বাকি টাকায় পানি নিষ্কাশন নালার পুরোটা যথাযথভাবে পরিষ্কার করা ও খাল খনন করা সম্ভব নয়।

যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কত টাকা প্রয়োজন, জানতে চাইলে ওয়াসার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, এ জন্য ৬০-৭০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এ জন্য চলতি বছর মন্ত্রণালয়ের কাছে ৬০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। গত বছর চাওয়া হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। কিন্তু তারা সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা করে দিয়ে যাচ্ছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে ওয়াসা স্থানীয় সরকার বিভাগকে একাধিক চিঠি দিয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ না পাওয়ায় ওয়াসা খাল খনন, বক্স কালভার্ট ও পাইপলাইন যথাযথভাবে পরিষ্কার করতে পারেনি। ফলে গত বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। একই চিঠিতে এবার ৬০ কোটি টাকা চাওয়ার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, এই টাকা না পাওয়ায় এবার খাল খনন, বক্স কালভার্ট ও পাইপলাইন পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। বরাদ্দ না বাড়ালে আগামী বর্ষায় ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে মারাত্মক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি (আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা হবে না) রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া নতুন নর্দমা নির্মাণের কাজ করে ড্রেনেজ গবেষণা ও উন্নয়ন সার্কেল। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগারগাঁও এলাকায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন নালা নির্মাণই ওয়াসার সর্বশেষ কাজ। এখন আর ওয়াসার হাতে নতুন কোনো প্রকল্প নেই। ফলে এই সার্কেলেরও তেমন কোনো কাজ নেই।

ওয়াসার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (ড্রেনেজ) বিভাগের কাজ মূলত লেভেল সার্ভে, পাইপের আকার নির্ধারণ ও ড্রেনের নকশা তৈরি করা। নতুন প্রকল্প না থাকলে এই বিভাগেরও কাজ থাকে না।

জানা গেছে, এ বছরের জন্য ওয়াসা দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু গত জানুয়ারিতে একনেক থেকে প্রকল্প দুটি প্রত্যাহার করে নেয় মন্ত্রণালয়। প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রকল্পের একটি হচ্ছে পাঁচটি খালের (হাজারীবাগ, বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মাণ্ডা ও বেগুনবাড়ি) জমি অধিগ্রহণ ও পুনঃখনন প্রকল্প এবং অন্যটি কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনসংলগ্ন রেগুলেটরি পন্ড সংরক্ষণ প্রকল্প।

ওয়াসা সূত্র বলছে, ওয়াসা ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে মান-অভিমানের কারণেই প্রকল্প দুটি একনেক থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের পরিমাণ ও বাতিল হওয়া প্রকল্প দুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।’

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হয়। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। পরে মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব জাফর আহমেদ খান ও সদ্য বিদায়ী সচিব আবদুল মালেককে ফোন করা হয়। তাঁরাও ফোন ধরেননি। তাই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

ড্রেনেজ সার্কেলে ওয়াসার নিজস্ব বরাদ্দ না বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তাকসিম এ খান বলেন, ‘বরাদ্দ কিছু না। ওয়াসার যখন যেমন টাকা থাকে, তখন তেমন ব্যয় করি। ড্রেনেজে আমাদের অংশের কাজকর্ম ঠিকই আছে। এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে ওয়াসার প্রস্তুতি জানানো হবে।’

পরিস্থিতি শুনে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেছেন, ওয়াসা মূলত পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কাজ করে। এর মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ভর্তুকি খাত। এখান থেকে ওয়াসার কোনো আয় নেই। তাই এ খাতে ওয়াসার মনোযোগও নেই। এই অবহেলার ফল ভোগ করতে হয় রাজধানীবাসীকে। আর নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বললেন, গতবারের জলাবদ্ধতার পর এবার যেমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক কাজ হওয়া উচিত ছিল; সেটা দেখা যাচ্ছে না। এখন দোয়া করতে হবে এবার যেন গত বছরের মতো এক সঙ্গে বেশি বৃষ্টি না হয়।