কর ছাড় দিয়েও সড়কে সৌন্দর্যের দেখা নেই

সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের শর্তে বিনা করে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ দেওয়া হলেও রাস্তার অবস্থা মলিন। সম্প্রতি রাজধানীর বিজয় সরণিতে
ছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর বিজয় সরণি সড়কটিতে সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব আর কে মাল্টিমিডিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। কথা ছিল, সড়কটির সৌন্দর্য বাড়ানোর বিনিময়ে বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তারা যে আয় করবে, সেখান থেকে সিটি করপোরেশনকে কোনো কর দিতে হবে না।

সরেজমিনে গতকাল সোমবার দেখা যায়, বিজয় সরণির নির্ধারিত অংশে ৩১টি এলইডি বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সড়কটির সৌন্দর্য মলিন। আছে শুধু ঘাস, তা–ও অনেক জায়গায় মরে গেছে। সব মিলিয়ে ঢাকার অন্যান্য সড়কের যে দশা, এই সড়কের অবস্থা ভিন্ন কিছু নয়।

বিজয় সরণির মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তিনটি সড়ক এবং একটি স্থাপনায় সৌন্দর্যবর্ধনের অনুমতি পেয়েছে চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কাকলী মোড় থেকে গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের বিভাজকে কন্টিনেন্টাল হোল্ডিং লিমিটেড, কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারায় ওজন ব্লু বাংলাদেশ লিমিটেড এবং মহাখালী উড়ালসড়কের ওপরে ও নিচে ইউনিকম মিডিয়া লিমিটেড দায়িত্ব পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে এলইডি কিংবা ট্রাইভিশন সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। তবে সড়কের সৌন্দর্য অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এসব সড়কে ফুল ও পাতাবাহারগাছ লাগানো হয়েছে। যদিও যত্নের বেশ অভাব।

উত্তর সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া জানান, ডিএনসিসি এলাকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের জায়গায় এলইডি সাইনবোর্ডের জন্য বর্গফুটপ্রতি বিজ্ঞাপন কর ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে আরও তিন হাজার টাকা মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) রয়েছে। তিনি বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। সৌন্দর্যবর্ধন ছাড়া কেউ বিজ্ঞাপন প্রদান বা প্রদর্শন করতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত হারে কর দিতে হবে।

উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগের দাবি, সড়ক বরাদ্দ পাওয়া চার প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শিত বিজ্ঞাপন থেকে করপোরেশনের বছরে ১২ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আয় হতে পারত। এখন আয় হচ্ছে না, বিপরীতে সৌন্দর্যবর্ধন আহামরি কিছু নয়। এ ছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, অনুমতি পাওয়া সড়কের চারপাশে ৫০ ফুটের মধ্যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যায় না।

উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগের দাবি, সড়ক বরাদ্দ পাওয়া চার প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শিত বিজ্ঞাপন থেকে করপোরেশনের বছরে ১২ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আয় হতে পারত। এখন আয় হচ্ছে না, বিপরীতে সৌন্দর্যবর্ধন আহামরি কিছু নয়।

উত্তর সিটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এটি আসলে সৌন্দর্যবর্ধন নয়, করপোরেশনের কর এড়িয়ে বিনা টাকায় বিজ্ঞাপন প্রচারটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সৌন্দর্যবর্ধনের মোড়কে যে পরিমাণে রাজস্ব ছাড় পাচ্ছে, তার চেয়ে কম খরচে সিটি করপোরেশনই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের বিষয়টি সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতাধীন ছিল। এখন রাজস্ব বিভাগের কাছে রয়েছে। তবে রাজস্ব বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকানা বা যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যায়নি।

বিজয় সরণি, কাকলী-গুলশান, মহাখালী ও সার্ক ফোয়ারা ছাড়াও উত্তর সিটি এলাকার নয়টি সড়কে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সৌন্দর্যবর্ধনের অনুমতি পেয়েছে। তবে এসব সড়কে বিজ্ঞাপন তেমন একটা প্রচার করা হয় না।

সূত্র জানায়, মেয়র আনিসুল হকের সময়ে রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধনে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য অংশীজনদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, যে উদ্দেশ্যে বা শর্তে এই কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হলে সার্থকতা আসত, কিন্তু তা হয়নি। এখন এ কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উত্তর সিটির চারটি বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে।

শহরের সৌন্দর্যবর্ধন সিটি করপোরেশনের একটি মৌলিক কাজ। এটি সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে। এখন যে প্রক্রিয়ায় কাজটি হচ্ছে, তাতে রাজস্ব আয়ে ছাড় দিতে হচ্ছে, কিন্তু সৌন্দর্য হচ্ছে না।
অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগ জানিয়েছে, গত তিন অর্থবছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০) বিজ্ঞাপন খাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ২৩ কোটি টাকা। বিপরীতে আয় হয় ১৮ কোটি টাকা। তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আয় বেশি হচ্ছে। কারণ, সিটি করপোরেশন বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়াতে অভিযান চালাচ্ছে। করপোরেশনের হিসাবে, এ অর্থবছরে ১৫ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যের বিপরীতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আদায় হয়েছে ৬ কোটি টাকার বেশি।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, শহরের সৌন্দর্যবর্ধন সিটি করপোরেশনের একটি মৌলিক কাজ। এটি সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে। এখন যে প্রক্রিয়ায় কাজটি হচ্ছে, তাতে রাজস্ব আয়ে ছাড় দিতে হচ্ছে, কিন্তু সৌন্দর্য হচ্ছে না। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় অন্য কাউকে সুবিধা দেওয়ার বিষয় থাকতে পারে।