ঢাকার উদ্যানে গাছ আর ইট–পাথর সমানে সমান

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের জন্য গাছ কাটা হয়েছে
ছবি প্রথম আলো

এমনিতেই ঢাকা শহরে গাছপালা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। রাজধানী শহরটি বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরগুলোর মধ্যেও একটি। তারওপর উদ্যানগুলোয় বেড়েই চলেছে কংক্রিটের পরিমাণ।

একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তবে সরকারের তথ্যমতে দেশে মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি (বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা)। কিন্তু ঢাকা শহরে সেটি খুবই কম, যদিও শহরটিতে জনসংখ্যা রয়েছে দুই কোটির ওপরে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) মতে, ঢাকায় সবুজের পরিমাণ শহরটির মোট আয়তনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ। তবে শুধু গাছের হিসাব করলে সেটি আরও কম।

ঢাকার সবুজের একটি বড় অংশই দখল করে আছে উদ্যান ও কিছু পার্ক। কংক্রিটের এই শহরে সাতটির মতো বড় উদ্যান রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের আয়তন ২০৮ একর, চন্দ্রিমা উদ্যান ৭৪ একর, রমনা পার্ক ৬৯ একর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ৬৮ একর, ওসমানী উদ্যানের আয়তন ২৩ একর, বাহাদুর শাহ পার্ক প্রায় ২৪ একর ও বলধা গার্ডেন ৩ দশমিক ৩৮ একর।

এ ছাড়া গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্ক, লেকপার্ক, বারিধারার লেকভিউ পার্কসহ আরও কিছু পার্ক রয়েছে ঢাকাজুড়ে। রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, চিড়িয়াখানা এলাকা, সংসদ ভবন এলাকা ও ধানমন্ডির মতো কিছু সবুজ এলাকা। এ স্থানগুলোর বেশ কয়েকটিতে রয়েছে কাঠবিড়ালিসহ নানা প্রাণী।

কিন্তু ক্রমেই এসব এলাকাও চলে যাচ্ছে কংক্রিটের দখলে। তার সর্বশেষ উদাহরণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ছোট-বড় অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আরও অনেক গাছ কাটার জন্য চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে কংক্রিটের পরিমাণ।

যদিও সরকার বিভিন্ন সময় বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কংক্রিটের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘অপ্রয়োজনীয় গাছ’ কেটে ফেলেছে। বিপরীতে আরও বেশি গাছ লাগানো হবে।

ঢাকার উদ্যানের বড় অংশজুড়ে কংক্রিট

দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ঢাকা শহরের আয়তন প্রায় ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার—উত্তরে ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গ কিলোমিটার ও দক্ষিণে ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গ কিলোমিটার। যদিও দুই সিটি বর্ধিত হওয়ার আগে সেখানকার আয়তন ছিল প্রায় ১৩০ বর্গ কিলোমিটার।

সেই হিসাবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের এক গবেষণা অনুসারে, মোট এলাকার মধ্যে কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকা ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ, খোলা জায়গা ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ, জলজ ভূমি ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও সবুজ আচ্ছাদন ৯ দশমিক ২ শতাংশ।

গবেষণা অনুসারে, ১৯৯৯ সালে সবুজে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ছিল ঢাকার মোট এলাকার ৮ দশমিক ৯৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১৯ সালে সেটি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩৩ বর্গ কিলোমিটার। আপাতদৃষ্টিতে সবুজের পরিমাণ বেশি মনে হলেও বাস্তবিকভাবে তা কমেছে।

গবেষণা বলছে, গত ২০ বছরে সবুজে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৩৭ শতাংশ।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে জলাশয়গুলো ছিল, তার একটি বড় অংশ ভরাট হয়েছে। সেগুলো রূপান্তর হয়ে ঘাস জমে গেছে। কিন্তু এগুলো আসলে কয়েক দিন পর থাকবে না। আসলে আমরা সবুজ এলাকা বাড়াচ্ছি না। অস্থায়ী সবুজ তৈরি হচ্ছে ভরাট করা জায়গায়।’
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সবুজ এলাকা কমছে। ব্যক্তিগত প্লটও ছিল, যেগুলো সবুজ ছিল, পরে এই সবুজ নষ্ট হয়েছে। সবুজ হচ্ছে জলাভূমি। জলাভূমিও বাড়েনি। উল্টে কমেছে। অস্থায়ী (টেম্পোরারি) সবুজ বেড়েছে।’

উদ্যানে ৫ ভাগের বেশি কংক্রিট নয়

আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আছে, উদ্যানে ৫ শতাংশের বেশি অবকাঠামো করা যাবে না। আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশ স্থাপনাও অনুমোদন করে না। সিটি করপোরেশনের আন্ডারে মাঠগুলোয় কংক্রিট আর কংক্রিট। গ্লোবালি কোনো পার্কের ডিজাইনে এমন কংক্রিটের ডিজাইন নেই।

তবে ঢাকার সবুজের যে বড় অংশজুড়ে রয়েছে ঢাকার উদ্যানগুলো, তার একটি বড় অংশই কংক্রিটের দখলে। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রস্তাবিত স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পে কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া বনানী পার্কে কংক্রিটের পরিমাণ ৪২ শতাংশ, গুলশান-২-এর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে ৩৮ শতাংশ।

তবে ওসমানী উদ্যানে সবুজের চেয়ে কংক্রিট বেশি, ৫২ শতাংশ।

এ ছাড়া উদ্যানে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণে গণশুনানির কথা থাকলেও তা করা হয় না। এ বিষয়ে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো উদ্যানে কংক্রিট নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সে ক্ষেত্রে গণশুনানি করতে হয়। কিন্তু কোনো উদ্যানের ক্ষেত্রেই কংক্রিট নির্মাণের সময় গণশুনানি হয়নি, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পের ক্ষেত্রে।

মোবাশ্বের হোসেন বলেন, জনগণের ব্যবহারে যে জিনিস আসবে, তাদের তা জানাতে হবে। প্রথমত, সেটা তাদের গ্রহণ করার মতো করে তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত তাদের চেতনার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তা নেই।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে পরিবেশবিদদের পরামর্শ নেওয়া হয় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নগর নকশাবিদ, উদ্যানতত্ত্ববিদ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শ ছাড়াই করা হয় প্রকল্প। ফলে, কংক্রিট নির্মাণের ক্ষেত্রে সবুজের ওপর চলে কাটছাঁট অথবা সবুজকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না।

কয়েকটি সংগঠনের অভিযোগ, এবার অন্তত ১৫০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

উদ্যানের গাছ কাটা ফৌজদারি অপরাধ

পরিবেশবিদ, স্থপতি ও আইনজীবীরা বলছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় পরিসরে অবকাঠামো নির্মাণ উদ্যানের ‘উদ্যান চরিত্র’ নষ্ট করবে, যা ‘উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০২০’-এর লঙ্ঘন।
এ আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী, ‘এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না।’

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আইনে আছে শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারবে না। শ্রেণি পরিবর্তন বিষয়টা হচ্ছে গ্রিনারি ডেমলিশ (সবুজ ধ্বংস) করে কতগুলো ভবন করে ফেলা। এগুলো করা যাবে না।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, কেউ তা করলে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। নইলে জেল জরিমানা হবে। এখানে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, ঢাকায় একটা গাছ কাটাও ফৌজদারি অপরাধ। এখানে সবুজ খুব কম। গত এক দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই নগরীর বাতাস উত্তপ্ত। জনগণকে বিশুদ্ধ বাতাস দিতে হলে একটা গাছও কাটার কোনো সুযোগ আছে? এখানে মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে।