ঢাকার খাল–নালার দায়িত্ব পেল দুই সিটি করপোরেশন

ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব এখন ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। আগের এ দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। সে লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হচ্ছে। স্মারক সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, দুই সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ফজলে নূর তাপস এবং ওয়াসার এমডি তাকসিন এ খান। ছবিটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে তোলা
ছবি: সাজিদ হোসেন

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ–সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে এখন থেকে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব পেল দুই সিটি করপোরেশন। আগে এ দায়িত্বের সিংহভাগ পালন করত ঢাকা ওয়াসা।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানটি হয় রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ২০১২ সালে ঢাকা ওয়াসা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার (খাল ও নালা রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন) দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী হিসেবে তাজুল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার পর এ উদ্যোগে গতি আসে। এর ফলে আজকের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি হয়। এর মাধ্যমে ঢাকা শহরের বৃষ্টি-বর্ষা ও প্লাবনের পানিনিষ্কাশন আরও বেগবান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানে সিটি জরিপ অনুসারে অনতিবিলম্বে ঢাকা শহরের খালের সীমানা চিহ্নিত করার প্রতি জোর দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ ছাড়া খালের দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পুনঃখনন করে পানিধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাড় বাঁধাই করে সবুজায়ন, ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) এবং সাইকেল লেন তৈরির পক্ষে মত দেন তিনি। আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখেছি, খালের সঙ্গে পয়োনালার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেফটি ট্যাংক করে এমন সংযোগ বন্ধ করতে হবে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে।’ ঢাকার পশ্চিমাংশে বাঁধ তৈরি করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিএনসিসির মেয়র বলেন, ঢাকার পূর্বাংশে বালু নদীর পাশ দিয়ে যে রাস্তা তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অবশ্যই ‘এলিভেটেড’ হতে হবে। ‘খাল তুমি কার’, নিজের এমন উদ্ধৃতির কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আজ খাল ঠিকানা পেল। আজ থেকে খাল সিটি করপোরেশনের হয়ে যাচ্ছে। এসব খাল পরিষ্কার করে খালে আগের মতো পানির গতি ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আতিকুল ইসলাম।

ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হন্তান্তরকে ঐতিহাসিক দিন হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি এ–সংক্রান্ত বিশাল কর্মযজ্ঞের ঘোষণা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকা শহরে পানি জমলে কাল থেকেই প্রশ্ন উঠবে, কিন্তু ডিএসসিসি এ ব্যাপারে প্রস্তুত। তিনি বলেন, আগামী পরশু (শনিবার) থেকে ঢাকার জিরানি, মান্ডাসহ তিনটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট (পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা) পরিষ্কার করার কাজ শুরু করা হবে। আগামী তিন মাসে এ কাজ করা হবে। কালুনগর খাল আংশিক পরিষ্কার করা হয়েছে। এরপর ধোলাই খাল ও বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল নিয়ে কাজ করা হবে। ডিএসসিসি নিজস্ব অর্থায়নে কাজগুলো করবে। এ ছাড়া খাল-নালা উন্নয়নে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হবে বলেও জানান ডিএসসিসি মেয়র। ঢাকা শহরের খালগুলো উদ্ধার ও পরিষ্কার করে ঢাকা শহরকে একটি নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ার ঘোষণা দেন ফজলে নূর তাপস।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সারা বাংলাদেশকে উন্নত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রী তা পূরণ করে চলেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরকে আমরা দৃষ্টিনন্দন, বাসযোগ্য, স্বাস্থ্যকর নগরীতে রূপান্তর করতে চাই। ঢাকা শহরকে ঠিক করতে হলে যার যে দায়িত্ব, সেটি সঠিকভাবে পালন করতে হবে। যে কাজ আমি করলে ঠিক হবে সেটি আমি করব, আর যে কাজ আমি করলে ঠিক হবে না, সেটি ধরে রাখা ঠিক হবে না।’

ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, ১৯৬৩ সালে এটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়। যদিও কাজটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কাজ। হস্তান্তর সম্পর্কে তিনি বলেন, এ–সংক্রান্ত বহু আলোচনা–পর্যালোচনা হয়েছে। এরপর একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে সেগুলো মূল্যায়ন করা হয়েছে। কমিটির ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের হস্তান্তরের প্রস্তাব করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে আজ হস্তান্তরের জন্য সমঝোতা স্বাক্ষর হচ্ছে। সে অনুযায়ী ড্রেনেজ–সংক্রান্ত ঢাকা ওয়াসার জনবল ও সম্পদ দুই সিটি করপোরেশনের কাছে চলে যাবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, আজকের দিনটি (সমঝোতায় স্বাক্ষর) দীর্ঘদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল। মন্ত্রীর চেষ্টা, দুই মেয়রের আগ্রহ ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হচ্ছে। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে মন্ত্রণালয় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়ে সরকারি এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আশা করি, আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা হবে না।’

ড্রেনেজ–ব্যবস্থা হস্তান্তরসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান এবং ডিএসসিসির পক্ষে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ও ডিএনসিসির পক্ষে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষর করেন। এ সময় তিন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর থেকেই ঢাকায় একটু ভারী বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। এটি নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাঁধে থাকলেও সিটি করপোরেশনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও জড়িত।

জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের ২৬টি খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে। দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। আজ থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের হাতে গেল।