ঢাকার দুই সিটির কঠিন বর্জ্য মহাপরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কী

রাজধানীর উন্মুক্ত স্থানে ময়লার ভাগাড়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারে সদস্যপ্রতি গড়ে দৈনিক কঠিন বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪৯৬ গ্রাম। মধ্যবিত্ত পরিবারে তা ৪৮৩ গ্রাম ও নিম্নবিত্ত পরিবারে ১৯৩ গ্রাম। এই বর্জ্যের বড় অংশ খাদ্যবর্জ্য। এভাবে বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় দৈনিক সাড়ে ৭ হাজার টনের বেশি কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। সারা দেশের কথা বিবেচনা করলে দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ আরও বেশি।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে কোনো আধুনিক ও পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলছে অনেকটা ‘দিন আনি, দিন খাই’–এর মতো করে। বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে, আর কোনো ধরনের পৃথক্‌করণ ছাড়াই যতটুকু পারা যাচ্ছে প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকিটা চলে যাচ্ছে নদী, খাল ও পানিনিষ্কাশন নালায়। এই সনাতন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশগত দিকটি থাকছে উপেক্ষিত। এমন ব্যবস্থাপনা নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রাও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ঢাকার দুই ল্যান্ডফিলের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পথে। ছবিটি দক্ষিণ সিটির মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের
ছবি: প্রথম আলো

পরিস্থিতি বদলাতে ১৫ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়ন করেছিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এতে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। আড়াই বছর আগে খসড়া মহাপরিকল্পনার অনুমোদন দেয় দুই সিটি করপোরেশন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে এটি স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়।

প্রায় ২৭ মাস ওই খসড়া আটকে থাকার পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি সেটির অনুমোদন দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে মহাপরিকল্পনা অনুমোদনের সঙ্গে কিছু শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মহাপরিকল্পনা থেকে প্রযোজ্য (আংশিক/সম্পূর্ণ) অংশ সিটি করপোরেশন নিজেদের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ব্যবহার করবে। এটি অনুমোদন দেওয়া হলেও চলমান ওয়েস্ট টু এনার্জি (বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ) প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে না বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের এমন ‘অদ্ভুত’ নির্দেশনার কারণ—অনুমোদনের আগেই মহাপরিকল্পনা থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সরে যাওয়া।

ঢাকার দুই ল্যান্ডফিলের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পথে। ছবিটি উত্তর সিটির আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের
ছবি: প্রথম আলো

দুই সিটির সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘ইকো টাউন’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী বায়োগ্যাস, কম্পোস্ট, রিসাইকেল, কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে সরে এসে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বলছে, সব ধরনের বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিএমইসি) সঙ্গে চুক্তি করেছে ডিএনসিসি। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করবে ডিএনসিসি। এরপর উৎপাদিত বিদ্যুৎ নির্ধারিত দামে কিনবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

ঢাকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্পটি অত্যন্ত জটিল, বাস্তবায়ন কষ্টসাধ্য। কারণ, রাজধানীর বর্জ্যে ভেজা বা তরল অংশের পরিমাণ বেশি থাকে, যা থেকে বিপুল পরিমাণ তাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। ঢাকার প্রতি কেজি বর্জ্যে ৬০০ কিলোক্যালরি ক্যালিরিফিক ভ্যালু (বর্জ্যের দাহ্য হওয়ার ক্ষমতা) থাকে। অথচ ১০০০ কিলোক্যালরি না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে কোনো আধুনিক ও পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলছে অনেকটা ‘দিন আনি, দিন খাই’–এর মতো করে।

মহাপরিকল্পনা থেকে ঢাকা উত্তর সিটি অনেকটা সরে গেলেও দক্ষিণ সিটি মহাপরিকল্পনামতোই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য ‘মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল’ (আবর্জনা ফেলার স্থায়ী জায়গা) সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়নে ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলমান। এই প্রকল্পের আওতায় ৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) করা হবে।

দুই সিটির মহাপরিকল্পনা মূলত একই ধরনের। কার্যকর ও স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, বিদ্যমান ল্যান্ডফিল দুটির (অপরটি আমিনবাজারে) আয়ুষ্কাল বাড়ানো, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, অংশীজনদের সক্ষমতার উন্নয়ন—অনুমোদন দেওয়া মহাপরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। উত্তর সিটি অনেকটা সরে যাওয়ায় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ মহাপরিকল্পনার আংশিক বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়ায় এটির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

দুই সিটির সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘ইকো টাউন’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী বায়োগ্যাস, কম্পোস্ট, রিসাইকেল, কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে সরে এসে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে

পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ডিএনসিসির বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কতটা বদলাবে তা অনেকাংশে নির্ভর করছে মহাপরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে নেওয়া এ প্রকল্পের সফলতার ওপর।

মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৩২ সালে রাজধানীতে দৈনিক বর্জ্য হবে সাড়ে ৮ হাজার টন। মহাপরিকল্পনার প্রতিপাদ্য, ‘সমন্বিত ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে উন্নত শহর: শূন্য বর্জ্যের পথে’। ‘বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃ চক্রায়ণ (রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল)’—মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে এই ত্রি-আর বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।

এক সিটি মহাপরিকল্পনা থেকে অনেকটা সরে যাওয়ায় এখন এই ত্রি-আর আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।