ঢাকার ফ্রিম্যাসন্স হলের সত্য-মিথ্যা
রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে—মুক্তাঙ্গনের একপাশে একটি পুরোনো দোতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে। সাদামাটা একটি ভবন। এটি এখন ভূমি মন্ত্রণায়লের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়। ভবনটির গায়ে থাকা একটি ফলক যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘ফ্রিম্যাসন্স হল ১৯১০’। অর্থাৎ ভবনটি ১১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে দেখে মনে হয়, ভবনটি একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ভবনটি কারা তৈরি করেছেন, কোন উদ্দেশ্যে তৈরি করলেন, সে বিষয়ে তথ্য নেই বললেই চলে। অনেকে বলেন, এটি ছিল ইহুদিদের ক্লাব। কেউ বলেন, এখানে ইহুদিরা গোপনে সভা করতেন। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল ইহুদিদের প্রার্থনার জায়গা। কিন্তু কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারেন না। ফ্রিম্যাসন শব্দের সঙ্গে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে এ হলটি যে ফ্রিম্যাসনদের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফ্রিম্যাসনরির সদস্যদের ফ্রিম্যাসন বলা হয়। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ বলছে, ফ্রিম্যাসনরি হলো একটি সংঘ। মধ্যযুগে ক্যাথিড্রাল তৈরি এবং পাথরের কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের দিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। ১৭১৭ সালে যুক্তরাজ্যে এই সংঘ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। ১৭৭৫ সালে লন্ডনে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ব্রিটানিকার তথ্য অনুযায়ী, ফ্রিম্যাসনরির কর্মকাণ্ড প্রচলিত অনেক ধর্ম থেকে ভিন্ন—অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত। ব্রিটানিকা আরও জানাচ্ছে, ফ্রিম্যাসনরি কোনো খ্রিষ্টীয় প্রতিষ্ঠান নয়। একটি ধর্মের বিভিন্ন উপাদান ফ্রিম্যাসনরিতে রয়েছে। ফ্রিম্যাসনরি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, দাতব্য কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। এটি প্রধানত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সংঘ। সংঘের সদস্যরা ঈশ্বর–বিশ্বাসী এবং তাঁরা মনে করেন আত্মা অমর। সংঘের সভ্যরা যেখানে মিলিত হন, তাকে ‘লজ’ বলা হয়।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেসব প্রতিবেদনে ফ্রিম্যাসন্স হলকে সরাসরি ইহুদিদের ক্লাব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে নেই কোনো তথ্যসূত্র। পুরানা পল্টনের ফ্রিম্যাসন্স হল সম্পর্কে জানতে প্রথম আলো কয়েকজন ইতিহাসবিদ ও ধর্মবিষয়ক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। একাধিক গবেষকের কথা, ঢাকার ফ্রিম্যাসন্স হলটিকে ‘ইহুদিদের ক্লাব’ বলে দেওয়া একেবারে অযৌক্তিক।
ফ্রিম্যাসনেরা বাইবেলে বর্ণিত সলোমনের অনুসারী, এমনটা জানান গবেষক ডেনিস দিলীপ দত্ত। তিনি বলেন, ফ্রিম্যাসনেরা একটি গুপ্ত সংঘ। তারা খ্রিষ্টান নন, ইহুদিও নন। তবে মানবাধিকারের মূল্যবোধের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল গভীর। দাতব্য কাজে তাদের আগ্রহ ছিল বেশি।
মানবাধিকার ও ইতিহাস নিয়ে একাধিক বইয়ের লেখক ডেনিস দিলীপ দত্ত ফ্রিম্যাসন্স হলটি সম্পর্কে বলেন, এ হলটি আগে আরও বড় ছিল। এখানে ফ্রিম্যাসনদের একটি ক্লাব ছিল। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর সম্পাদক ফাদার বুলবুল অগাস্টিন রিবেরো প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্রিম্যাসনরা ক্যাথলিক ছিলেন না, এটা নিশ্চিত। তাদের একসময় ক্যাথলিকেরা ভালো চোখে দেখতেনও না। কিন্তু পরে তাদের সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যায়। আসলে ফ্রিম্যাসনরি একটি সংঘের মতো।’
ব্রিটানিকা বলছে, বিশ্বের অনেক ফ্রিম্যাসনরি লজ ইহুদি, ক্যাথলিক ও কৃষাঙ্গবিরোধী। লেখক–কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার হাতে গোনা ইহুদিরা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গেই চলাফেরা করত। এমন হতে পারে, এই হলে ইহুদিদেরও যাতায়াত ছিল। সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও বললেন, ‘পল্টন এলাকার দুটি প্রাচীন স্থাপনার কথা আমি জানি, একটি হলো রবীন্দ্র লাইব্রেরি, অন্যটি ফ্রিম্যাসন্স হল।’
ফ্রিম্যাসন্স হল ভবনের দপ্তরে কাজ করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ঢাকা বিভাগের সহকারী হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) ইসমাইল হোসেন মোল্লা। গতকাল রোববার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘আমরা লোকমুখে শুনেছি, এটি ইহুদিদের একটি প্রার্থনালয়। প্রায় ৭০ বছর ধরে এই ভবনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিস রয়েছে। ভবনটি জরাজীর্ণ।’ তিনি আরও জানান, ভবনটি ১০ কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কার্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, এই ভবনের জমির পেছনের অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে প্রায় ডজনখানেক দোকান।