ঢাকায় সাইকেল লেন হলো, তবে...

সাইকেল লেনে পার্ক করে রাখা হয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসছবি: দীপু মালাকার

কালো কুচকুচে পিচের ওপর সাদা, হলুদ, নীল রঙের প্রলেপ পড়ছে। আরও ঝকঝকে, তকতকে হয়ে উঠছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশের সড়ক। দিন দশেক ধরেই চলছে এই কর্মযজ্ঞ। গত শনিবার রাত ১০টার দিকে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাত ঘেঁষে কয়েকজন কর্মীকে কাজ করতে দেখা গেল। রাস্তায় সাইকেলের চিহ্ন বসাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতেই একজন বললেন, সাইকেল লেন হবে।

লেনে সাইকেল চালানোর কোনো সুযোগ নেই চালকদের
ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকার রাস্তায় সাইকেল লেন হচ্ছে, এমন খবরে সাইক্লিস্টদের খুশির অন্ত নেই। কদিন ধরে সাইক্লিং রিলেটেড ফেসবুক পেজগুলোর ফিড ভরে উঠছে নানা ছবি ও ভিডিওতে। অনেকে এতে খুশি। কারও কারও মন খারাপ। কারণ, সাইকেলের লেন হিসেবে সড়কের সর্ব বাঁয়ের যে অংশটি বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটি ফুচকা, চটপটি ও চা বিক্রেতাদের দখলে। আর মোটরসাইকেল, গাড়ির পার্কিং তো আছেই। বিকেল থেকে লোকজন বেড়াতে আসেন সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার এই পাশটায়। অনেকে আসেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। সে কারণে রাত ১১টা–১২টা অবধি ফুটপাত ঘেঁষে রাস্তার ওপর মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি দাঁড় করানো থাকে। এখন সেখানটাতেই করা হলো সাইকেল লেন। এই লেন ব্যবহার আদৌ কতটা করা যাবে, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাইক্লিস্টরা।

সাইকেল লেনে চলছে অটোরিকশা। আবার উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল
ছবি: দীপু মালাকার
মো. জাহের

মো. তুষার নামের এক সাইক্লিস্ট বললেন, ‘সরকার এত এত টাকা খরচ করে সাইকেল লেন বানাল। কিন্তু আমরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছি না। সুবিধা পাচ্ছে অবৈধভাবে পার্ক করে রাখা যানবাহনের মালিকেরা।’
এদিকে বছরের পর বছর ধরে মানিক মিয়ার রাস্তার পাশে ব্যবসা করে আসা ব্যবসায়ীরা আছেন শঙ্কায়। তাঁদের ভয়, এই লেনের কথা বলে আবার না তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়! দু–তিনজন চটপটি ও ফুচকা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনাকালে তাঁদের ব্যবসা বলতে কিছু ছিল না। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই উচ্ছেদ–আতঙ্কে ভুগছেন।
২০ বছর ধরে সংসদ ভবনের এই রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ দোকানে চটপটি, ফুচকা বিক্রি করেন মো. জাহের (৫০)। তিনজন কর্মচারী তাঁর দোকানে। তাদের বেতন দিনে ৪০০ টাকা করে। তাঁদের চারজনের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১৭। অর্থাৎ এই একটি দোকান থেকে ১৭ জনের মুখের আহার জোটে। ‘এখন উঠে যেতে হলে তাঁদের কী গতি হবে, সে আল্লাহই জানে’, হতাশভরা কণ্ঠে বললেন জাহের।

আনিসুল হক

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এই সাইকেল লেনের উদ্যোক্তা। উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (অঞ্চল–৫) ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করতেই তাঁদের এ উদ্যোগ। দু–তিন দিনের মধ্যে লেন তৈরির কাজ শেষ হবে। তখন সচেতনতামূলক কিছু সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দেওয়া হবে।
সাইক্লিস্টরা এখন তাঁদের লেন বুঝে নিতে চান। কিন্তু ব্যবসায়ীরা জায়গা ছাড়তে নারাজ। নতুন সাইকেল লেন নিয়ে তাই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। এ ব্যাপারে কথা হলো বিডিসাইক্লিস্টসের সদস্য ও ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আনিসুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, সাইকেল লেন নিঃসন্দেহে ভালো একটি উদ্যোগ। কিন্তু লেন শুধু বানিয়ে দিলেই হলো না। এখানে চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন ছিল। এখানে চটপটি, ফুচকাওয়ালারা বসবেন। তাঁরা কোথায় যাবেন? তাঁরা কি রাস্তার মাঝে চলে আসবেন? জায়গাটি বিনোদনের একটা ক্ষেত্র। প্রচুর লোক ঘুরতে আসেন। গাড়ি, মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখেন। এগুলো তাহলে কোথায় রাখবেন? লেন করার আগে এগুলো ভাবতে হতো। কারণ, এর সঙ্গে কয়েক শ, এমনকি হাজারো লোকের জীবিকা জড়িত।
আনিসুল হক নিজে নিয়মিত সাইকেল চালান। তাঁর পরামর্শ, কিছু পয়েন্টে অর্থাৎ যেসব স্থানে দোকান আছে, সেসব স্থানে লেনটা একটু সরিয়ে আনা যেতে পারে। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাইকেলচালকদের সুবিধার্থে তাঁরা দোকান ফুটপাতের দিকে সরিয়ে নিতে রাজি আছেন। কিন্তু তাঁদের যেন উচ্ছেদ না করা হয়।

মেয়র আতিকুল ইসলাম

ঢাকায় সাইকেল লেনের দাবি সাইক্লিস্টদের বহু পুরোনো। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সাইকেল লেন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবার সেটি বাস্তবায়িত হলো বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামের হাত ধরে। তিনি বলেন, ‘আগারগাঁওয়ে আরও আগে থেকে ৯ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেল লেন করা আছে। এবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক কিলোমিটার দীর্ঘ লেন করা হলো। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জো বাইকের প্রবর্তন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে একে ছড়িয়ে দিতে হবে। পরিবেশ, স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে সাইকেলে আমাদের আসতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, রাস্তা হকারদের জন্য নয়। সাইকেল লেনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।