তরুণদের এমনভাবে গড়তে হবে, যাতে দেশ হাজারো লতিফুর রহমান পায়
লতিফুর রহমান ছিলেন একজন বিরল মানুষ। সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দূরদর্শিতা, পরিবারের প্রতি যত্নশীল, বন্ধুবৎসল, দৃঢ়চেতা মনোভাব—সব দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অনন্য। তাই এ দেশের তরুণদের এমনভাবে গড়ে তোলা দরকার, যাতে হাজারো লতিফুর রহমান পাওয়া যায়।
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের স্মরণসভা ও মিলাদ মাহফিলে তাঁকে নিয়ে এসব কথা বলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, লতিফুর রহমানের পরিচিতজন ও গুণগ্রাহীরা। আর তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি যে মূল্যবোধ শিখিয়ে গেছেন, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান সে অনুযায়ীই পরিচালিত হবে।
বিশিষ্ট শিল্পপতি ও উদ্যোক্তা লতিফুর রহমান ৭৫ বছর বয়সে গত বুধবার কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে মারা যান। পরিবারের পক্ষ থেকে আজ রোববার অনলাইনে তাঁর স্মরণসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে শুরুতে লতিফুর রহমানের স্বজন ও বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁকে স্মরণ করেন। এরপর দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। সবাই তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
শুরুতে লতিফুর রহমানের বড় মেয়ে সিমিন হোসেন তাঁর বাবার জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বলেন, ‘১৯৭১ সালে আব্বু সব হারিয়েছিলেন। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই ট্রান্সকমকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাগোষ্ঠীতে পরিণত করেছেন। ছোট মেয়ে (শাজনীন তাসনিম রহমান) ও নাতিকে (ফারাজ আইয়াজ হোসেন) হারানোর মতো জীবনের দুটি বিয়োগান্ত ঘটনার পরও তিনি ভেঙে পড়েননি। নিজের মতো করে সব এগিয়ে নিয়েছেন।’
সিমিন হোসেন বলেন, ‘আব্বুর বড় শক্তি ছিলেন আমার মা (শাহনাজ রহমান)। মাকে ছাড়া তিনি হয়তো এই পর্যন্ত আসতে পারতেন না। তাঁরা দুজনে দেখিয়েছেন জীবনসঙ্গী বলতে আসলে কী বোঝায়।’
প্রয়াত বাবার উদ্দেশে সিমিন হোসেন বলেন, ‘আব্বু, তুমি আমাদের জন্য উদাহরণ তৈরি করে গেছ। আমরা যদি সামনে এগোই, তোমাকে, ফারাজ ও শাজনীনকে হৃদয়ে রেখেই এগোব। আমি তোমার বড় মেয়ে হিসেবে পরিবারের পক্ষ থেকে বলছি, তুমি আমাদের যে সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিখিয়েছ, আমরা সে অনুযায়ী চলব।’
সিমিন হোসেনের বক্তব্যের পর লতিফুর রহমানের বন্ধুস্থানীয় ব্যবসায়ী ও সহকর্মীরা একে একে বক্তব্য দেন। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, আপস বলতে কোনো শব্দ লতিফুর রহমানের অভিধানে ছিল না। তাঁকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু তাঁর নীতি ছিল, ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না।
মাহবুবুর রহমান বলেন, লতিফুর রহমান বিপুল অর্থ আয় করেননি। তবে তিনি যেটা আয় করেছেন, সেটা হলো ভাবমূর্তি। ব্যবসাজগতে নোবেল হিসেবে পরিচিত ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড ২০১২’ তিনি পেয়েছিলেন বিপুল অর্থ আয়ের কারণে নয়, বরং নৈতিকতা ও সততার জন্য।
পেপসিকোর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সাবেক চেয়ারম্যান সঞ্জীব চাড্ডা বলেন, ‘আমি জীবনভর যত মানুষের সঙ্গে মিশেছি, তাঁদের মধ্যে একজন অন্যতম অসাধারণ মানুষ ছিলেন লতিফুর রহমান। দৃঢ় মূল্যবোধ, সততা ও উচ্চমানের সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন পরিবারসচেতন ব্যক্তি ও একজন নেতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেখা হলেই আমি প্রতিবার তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখতাম।’ এ সময় তিনি লতিফুর রহমান সম্পর্কে পেপসিকোর সাবেক প্রধান নির্বাহী ইন্দ্রা নুয়ির একটি বার্তা পড়ে শোনান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী হংকংয়ে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, তিনি ও লতিফুর রহমান পরিবারসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেদিন ছিল মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রীর (প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর) জন্মদিন। নিলুফার ঘড়ি পছন্দ করতেন। লতিফুর রহমানকে নিয়ে মঞ্জুর এলাহী একটি বিপণিবিতানে গিয়ে ঘড়ি কিনলেন। রসিদটি টেনে নিয়ে বিল দিলেন লতিফুর রহমান। মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘আমি বললাম, আমার স্ত্রীর জন্মদিনের উপহার আমারই কেনা উচিত। শামীম (লতিফুর রহমানের ডাকনাম) বলল নিলুফার আমার বোনের মতো। ওকে আমি এটা দিলাম। আপনি অন্য কিছু কিনে নেন।’
মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে যখন ভ্রমণ করতে যাওয়া হয়, তখনই তাঁকে চেনা যায়। ভালো–মন্দ বোঝা যায়। দেশের স্বাধীনতার পরপর পরিচয়ের পর থেকে লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা শুধু বেড়েছে।’
শুধু নিজের ব্যবসা নয়, ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে (এমসিসিআই) লতিফুর রহমান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেন মঞ্জুর এলাহী। উল্লেখ্য, লতিফুর রহমান সংগঠনটির সাতবার সভাপতি ছিলেন।
এমসিসিআইয়ের এখনকার সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘আমরা বলছি তাঁর মতো কেউ আসবে না। কিন্তু আমাদের উচিত দেশের তরুণদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে হাজারো লতিফুর রহমান তৈরি হয়। তাঁর ভালোবাসার বাংলাদেশ এমন মানুষ পায়, যারা তাঁর মতোই সব সময় দেশের ভালো করার চেষ্টা করে যাবেন।’
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গণতন্ত্রের প্রতি লতিফুর রহমানের ছিল অসম্ভব ভালোবাসা। এর কারণ ছিল, তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে, যতই ত্রুটি-বিচ্যুতি থাক না কেন। দুটি দৈনিক পত্রিকা চালাতে গিয়ে তাঁকে নানা সময় ক্ষমতাসীনদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যবসায় নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। তবু তিনি বলেছেন, তাঁর অন্য ব্যবসার চেয়ে এ দুটি পত্রিকা দেশের জন্য বেশি জরুরি।
মাহ্ফুজ আনাম একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘লতিফুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন। আমার লেখালেখির কারণে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তাঁকে (লতিফুর রহমান) সেই পদে রাখেননি। কিন্তু এ নিয়ে লতিফুর রহমান আমাকে কখনোই কিছু বলেননি। এমনকি রসিকতার ছলেও নয়।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘লতিফুর সব সময় আগে সালাম দিতেন। একদিন তিনি হঠাৎ অফিসে এলেন। একজন সাধারণ কর্মচারীকে সালাম দিলেন। আগে সালাম দিতে না পারায় ওই কর্মচারী হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। এতে অফিসে ওই দিন বিশেষ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।’
মতিউর রহমান বলেন, লতিফুর রহমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার। তিনি ৫০ বছরে একবারও পাকিস্তান যাননি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক কোটি এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি সব সময় বাংলাদেশের জয় দেখতে চাইতেন। তাঁর মৃত্যুর পর একটি বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়নি, যা বাংলাদেশে বিরল।
মতিউর রহমান প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সব সময় লতিফুর রহমানের পরিবার ও ট্রান্সকম গ্রুপের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘আমি আমার পরিবারকে বলতাম, আমার অবর্তমানে কোনো সমস্যা বা পরামর্শের জন্য শামীম ভাইয়ের কাছে যেতে। তিনি ছিলেন আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু।’
লতিফুর রহমানের বন্ধু হাসান আসকারি বলেন, ‘লতিফুর রহমান নৈতিকতায় এমন একটি উচ্চ অবস্থানে ছিলেন যে আমি সেখানে যেতে পারিনি।’
স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন লতিফুর রহমানের নাতি যারেফ আয়াত হোসেন। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ফারাজ (ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন) ছোটবেলায় বলত, সে নানাভাই হবে। তিনি আমাদের প্রতি খুবই যত্নশীল একজন মানুষ ছিলেন।’
যারেফ বলেন, ‘যা তাঁকে দেশের ব্যবসাজগতের আইকনে পরিণত করেছিল, সে কারণেই তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ নানাভাই। সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ দৃঢ়চেতা মনোভাব ও যত্নশীল। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, তাঁর লিগ্যাসি প্রজন্মের প্রজন্ম টিকে থাকবে।’