দীপন হত্যায় ৮ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড

দীপন হত্যা মামলার ছয় আসামিকে আজ আদালতে হাজির করা হয়
ছবি: হাসান রাজা

জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আজ বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামি হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির, আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল রিফাত, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। তাঁদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারাগারে থাকা ছয় আসামিকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। এ সময় আসামিদের প্রত্যকের গায়ে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে আদালতের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নজরদারি চালায়।

আসামিদের প্রত্যকের গায়ে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট
ছবি: প্রথম আলো

এই মামলায় গত ২৪ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি নিয়ে আদালত ১০ ফেব্রুয়ারি (আজ) রায় ঘোষণার দিন রাখেন। সে অনুসারে আজ রায় ঘোষণা করা হলো।

রাষ্ট্রপক্ষে এই মামলায় ২৩ জনকে আদালতে হাজির করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগ এলাকার আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে ফয়সল আরেফিন দীপনকে ঘাড়ের পেছনে আঘাত করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা অফিসের দরজা বন্ধ করে পালিয়ে যায়। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রযুক্তিগত তদন্তে জানা যায়, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করেছে।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন গোলাম ছারোয়ার খান। আর আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এ বি এম খায়রুল ইসলাম।

নিরাপত্তার অংশ হিসেবে আসামিদের হেলমেট পরানো হয়
ছবি: প্রথম আলো

অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, আসামি মইনুল হাসান শামীম জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্বীকার করেন, তিনিসহ অন্য সহযোগীরা মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এ ঘটনা ছাড়াও তাঁরা বাংলাদেশের আরও কয়েক জায়গায় ব্লগার, প্রকাশক ও লেখকদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এসব হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া এবং সেলিম ওরফে হাদী।

মইনুল হাসানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পলাতক আসামি আবদুস সবুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

অপর আসামি খাইরুল ইসলামও স্বীকারোক্তি দেন। আরেক আসামি আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন ও শেখ আবদুল্লাহ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, আসামি শেখ আবদুল্লাহ জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সংগৃহীত অর্থ জিয়া ও হাদীর কাছে পৌঁছে দিতেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি ও জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ফয়সল আরেফিন দীপনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন।

ফয়সল আরেফীন দীপন
ফাইল ছবি

অফিসে পড়ে ছিল রক্তাক্ত দেহ
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর। সেদিন বেলা দেড়টা পর্যন্ত ফয়সল আরেফিন দীপন বাসায় ছিলেন। দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বেলা দেড়টা পর্যন্ত দীপন তাঁর সঙ্গেই বাসায় ছিলেন। দুপুরের খাবার না খেয়েই শাহবাগে অফিসে যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে যান। পরে একাধিকবার ফোন করার পরও ফয়সল না ধরায় তিনি অধৈর্য হয়ে পড়েন। বিকেল চারটার দিকে তিনি আজিজ সুপার মার্কেটের তিনতলায় ১৩০ নম্বর রুমের সামনে যান। দীপনের অফিসের সামনে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখতে পান। এ সময় কাচের দরজা দিয়ে ভেতরে আলো জ্বলতে দেখেন। ছেলে বাইরে গেছে ভেবে তিনি সেখান থেকে চলে যান। পরে ছেলের বউকে ফোন করলে জানতে পারেন, দুর্বৃত্তরা লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদসহ (টুটুল) তিনজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ ঘটনা জেনে দীপনকে তাঁর স্ত্রী চিকিৎসক রাজিয়া রহমান ফোন করেন। কিন্তু দীপন ধরছিলেন না। পরে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক লোকজন নিয়ে আবার ছেলের কার্যালয়ে যান। এরপর দরজা খুলে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন ফয়সল আরেফিন দীপন।

ফয়সলের দোকানের কর্মচারী মো. আলাউদ্দিন বলেন, সেদিন বেলা একটা থেকে দেড়টার দিকে দীপনের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ দেখা হয়। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদের ওপর হামলার খবর শুনে তিনি বিকেল পাঁচটায় জাগৃতির কার্যালয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, দরজায় তালা ঝুলছে। তালার আরেকটি চাবি ছিল কম্পিউটার অপারেটর মহেশের কাছে। মহেশের কাজ শুরু হয় পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। আলাউদ্দিন মহেশকে দ্রুত চাবি নিয়ে আসতে বলেন। মহেশ আসার পর তালা খুলে ভেতরে ঢুকে ফয়সলের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন তাঁরা।

ফয়সলের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি থেকে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শন নামে দুটি বই প্রকাশ করা হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা তাঁর স্ত্রীকেও কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে।

ফয়সল আরেফিন উদয়ন স্কুলে অভিজিতের সহপাঠী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে লেখাপড়া করেন।

জঙ্গিদের জবানবন্দি
আসামি মোজাম্মেল হুসাইন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করেছেন। ২০১৪ সালে সিলেটের আবু বকরের মাধ্যমে তিনি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন। আর ওই বছর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে তাঁর সিলেটের টিলাগড়া এলাকায় পরিচয় হয়। জিয়া ছিলেন তাঁর মূল প্রশিক্ষক। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া দীপনকে হত্যার নির্দেশ দেন।

আসামি মইনুল হাসান শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ২০১০ সালে রাফি নামের হিযবুত তাহ্রীরের এক সদস্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি যখন সিলেটের মদনমোহন ডিগ্রি কলেজে পড়তেন, তখন রাফি তাঁকে জিহাদের কথা বলেন। ঢাকায় সেলিম ওরফে হাদীর কাছে পিস্তল চালানো শেখেন। দীপনকে খুন করার আগে তিনি নিজে আজিজ সুপার মার্কেট ও এর আশপাশের এলাকা রেকি করে আসেন। দীপনকে হত্যা করার পর সামরিক শাখার এক সদস্য প্রটেক্টেড টেক্সটে খুদে বার্তা পাঠান। এই খুনের মূল হোতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শেখ আবদুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি তাঁর বন্ধু আকিব বিন শাহরিয়ারের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন। পরে তাঁর সঙ্গে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার পরিচয় হয়। সংগঠনের কাজে তিনি প্রতি মাসে চট্টগ্রাম থেকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আনতেন।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খাইরুল ইসলাম বলেন, তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তেন। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। দীপনকে খুন করার আগে আজিজ সুপার মার্কেট এলাকায় রেকি করে আসেন। পরে তিনি জানতে পারেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার সদস্যরা দীপনকে হত্যা করেন।