দুই বান্ধবীর গল্প

ভেড়ার সঙ্গে গন্ডার কাঞ্চি। জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে গত বুধবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
ভেড়ার সঙ্গে গন্ডার কাঞ্চি। জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে গত বুধবার তোলা ছবি l প্রথম আলো

আকারে, গোত্রে বিপুল বৈসাদৃশ্য। স্বভাবেও নেই মিলের লেশমাত্র। একটির বিশাল বপুই আরেকটির স্বাভাবিক অবস্থানের জন্য হুমকি। একটির বেমক্কা এক গুতোই আরেকটির প্রাণবায়ু বের করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে দুটির মনই হয়তো সমান। কারণ মনের তো কোনো আকার নেই। আর সেখানেই হয়তো তারা একে অন্যের সহযাত্রী। 

গন্ডার আর ভেড়া। সত্যিই, মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় থাকা একমাত্র গন্ডারের সঙ্গে রয়েছে একটি ভেড়া। ঘাসের মোটা ডাঁটাটা খাচ্ছে গন্ডার আর কচি পাতাটা চিবোচ্ছে ভেড়া। কিন্তু এই অদ্ভুত সহাবস্থানের হেতু কী?

চিড়িয়াখানার পশুপালন কর্মকর্তা নাজমুল হুদা জানালেন সেই গল্প। ২০১১ সালে সাউথ আফ্রিকার একটি ফার্ম থেকে আনা হয় দুটি গন্ডার। মেনেস নামের এক ব্যক্তি ছিলেন গন্ডার দুটির মালিক। গন্ডার দুটি ছিল একে ওপরের সঙ্গী। ২০১৩ সালে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে মারা যায় পুরুষ গন্ডারটি। সঙ্গী হারিয়ে ভীষণ একা হয়ে যায় স্ত্রী গন্ডার। ওর নাম কাঞ্চি। সে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো যত্নেই সাড়া দেয় না। ওর চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বিভিন্নভাবে ওর মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়, কিছুতেই কিছু হয় না। পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই মেনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মেনেস বলেন, ‘আমি দু-এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে আসব। ওখান থেকে ফেরার পথে আমি কাঞ্চিকে দেখতে আসব।’

কয়েক দিনের মধ্যেই মেনেস আসেন চিড়িয়াখানায়। এসেই গন্ডারের খাঁচায় সরাসরি ঢুকে যান। অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর বের হয়ে এসে মেনেস বলেন, ‘ওর জন্য আমাদের এখন কিছু করার নেই। ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। কোনো ওষুধে কাজ হবে না। কিছুদিনের মধ্যে এভাবেই ও মারা যাবে।’

কিছুই কি করার নেই? তখন মেনেস বলেন, একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। ওর জন্য একটা তৃণভোজী সঙ্গী দেওয়া যেতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে মেনেসের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি স্ত্রী গাড়ল ভেড়া দেওয়া হলো গন্ডারের কাছে। আর এই ভেড়াই একাকিত্ব দূর করল কাঞ্চির। আবার হাঁটতে, খেতে শুরু করল কাঞ্চি। দুজনে যেন বন্ধু হয়ে গেল। ভেড়াটি বেশির ভাগ সময় কাঞ্চির গা ঘেঁষে শুয়ে থাকে। সারাক্ষণ থাকে পাশে পাশে। এভাবেই ওরা কাটিয়ে দিয়েছে চারটি বছর। এখনো অটুট রয়েছে ওদের বন্ধুত্ব।

একটি গন্ডার সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ বছর বাঁচে। কাঞ্চির বয়স এখন সাড়ে সাত বছর। আর কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে এভাবে একাকিত্ব দূর করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে নাজমুল হুদা বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় আমার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় এমনটা আর দেখিনি। তবে এভাবে প্রাণীর একাকিত্ব ঘোচানো সম্ভব, এটা কাঞ্চির মালিক মেনেসই আমাদের জানান।’