দুই বোনের দাবি, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না

বাড়ির সামনে দুই বোন মুশফিকা ও মোবাশ্বেরা
প্রথম আলো

গুলশান ২–এ ৯৫ নম্বর সড়কের ওপর প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর বাড়িটি। গৃহকর্তার মৃত্যুর পর মালিকানা নিয়ে বিরোধে তাঁর দুই মেয়ে অবস্থান নিয়েছেন বাড়ির সামনে। তাঁদের দাবি, বাড়ির দখল বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আঞ্জু কাপুরের হাতে। তিনি কিছুতেই ওই বাড়িতে তাঁদের ঢুকতে দিচ্ছেন না।
অবশ্য গৃহকর্তা মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের ছোটবেলার বন্ধু ও আইনজীবী মো. ওয়াজিউল্লাহর ভাষ্য আলাদা। ১০ অক্টোবর মোস্তফা জগলুলের মৃত্যুর পর আঞ্জু কাপুরকেও আইনগত সহযোগিতা তিনিই দিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্জু কাপুর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি চাইছেন, বাড়ির মালিকানা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে তা মিটে যাক। আস্থার সংকট থেকে তিনি বাড়ির দরজা খুলছেন না।
মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদ পেশায় পাইলট ছিলেন। যে জমির ওপর তাঁর বাড়ি, সেটি তাঁর মায়ের ছিল। পেছনে তাঁর ভাইবোনদের আরও প্লট রয়েছে। ভাইবোনদের মধ্যে শুধু সংগীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে নেই।
ঠিক কী হয়েছিল, তা জানতে বাড়ির সামনে অবস্থান নেওয়া মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের দুই মেয়ে মুশফিকা ও মোবাশ্বেরার সঙ্গে গতকাল রোববার কথা হলে তাঁরা জানান, গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত তাঁরা বাড়ির সামনে ছিলেন। গতকালও দিনভর গাড়ির ভেতর কেটেছে তাঁদের। তাঁরা বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

মুশফিকা বলেন, ১৯৮৪ সালে তাঁর বাবা মাকে নিয়ে গুলশানের এই বাসাতেই সংসার পেতেছিলেন। তাঁদের জন্ম ও শৈশবের বড় অংশও এই বাড়িতে কেটেছে। ২০০৫ সালে তাঁদের মা–বাবার বিচ্ছেদ হয়। পরে তাঁরা কখনো মায়ের সঙ্গে, কখনো বাবার সঙ্গে থাকতেন। ২০১৩ সালে তিনি উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য দেশ ছাড়েন। পরবর্তী ছয় বছর তিনি এই বাসায় অনিয়মিত হয়ে পড়েন। ছোট বোন মোবাশ্বেরাও বিয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তবে তাঁরা বাবার খোঁজখবর রাখতেন। তাঁদের বাবা বলেছিলেন, আঞ্জু কাপুর নামের একজন সেবিকা তাঁকে দেখাশোনা করছেন। পরে আঞ্জু নিজেকে তাঁদের বাবার স্ত্রী বলে দাবি করেন। তিনি একাই এখন এই বাড়ির ভোগদখল করছেন। এই ভবনের একদিকে ডেন্টাল ক্লিনিক আছে, একটা কারাতে স্কুল আছে। এগুলোর ভাড়াও আঞ্জু কাপুর তুলছেন। তাঁর বাবার ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়নি। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। অথচ মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটিমাত্র কেমোথেরাপি পেয়েছেন। এভারকেয়ার হাসপাতাল ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁদের বাবা ভর্তি ছিলেন। আঞ্জু কাপুর তাঁদের বাবার কাছে যেতে দেননি।
গতকাল ওই বাড়ির ফটকে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে ওই বাড়ির আশপাশের পুরোনো বাসিন্দারা বলছেন, তাঁরা মোস্তফা জগলুলের মৃত্যুর আগে তাঁর দুই মেয়েকে গত ১০ বছরেও আসতে দেখেননি।

সংগীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে আইন-আদালত আছে। যদি সত্যিই মেয়েরা বাড়িতে ঢুকতে না পারেন, তাঁরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তাঁরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। এমনকি তাঁর সঙ্গেও নয়।
আইনজীবী ওয়াজিউল্লাহ বলেন, মোস্তফা জগলুল প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একা হয়ে পড়েছিলেন। বেঙ্গালুরুর মেয়ে আঞ্জু কাপুর ঢাকায় তৈরি পোশাক খাতে চাকরি করতেন। পরে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালে তাঁর উপস্থিতিতে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে তাঁদের বিয়ে হয়। ২০১৬ সালে মোস্তফা জগলুল অছিয়ত করেন, তাঁর স্ত্রী আঞ্জু কাপুর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবেন। মেয়েদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্পত্তির দুই–তৃতীয়াংশ তাঁরা পাবেন। তবে তিনি মেয়েদের ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। গত বছর মেয়েরা বাইরের লোকজনসহ বাড়িতে ঢুকে অকথ্য ভাষায় আঞ্জু কাপুরকে গালাগাল করেন এবং তাঁর দিকে তেড়ে যান। তখন মোস্তফা জগলুল নিজেই গুলশান থানায় দুই মেয়ের নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পর আবারও দুই মেয়ে বাসায় আসেন। নিরাপত্তাহীনতায় থেকে আঞ্জু কাপুর আবারও গুলশান থানায় জিডি করেন।

এদিকে মোস্তফা জগলুলের দুই মেয়ে বলেছেন, বরং আঞ্জু কাপুরই তাঁদের গত বছর গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মূলত সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। সম্পত্তির বিরোধ মেটানো পুলিশের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ। তবে মোস্তফা জগলুলের মেয়েরা আঞ্জু কাপুরের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনে জিডি করেছেন, আঞ্জু কাপুরও করেছেন। এই জিডিগুলোই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গত বছর মেয়েদের বিরুদ্ধে তাঁদের বাবা জিডি করেছিলেন—এ তথ্যের সত্যতাও তিনি নিশ্চিত করেন।