দোকান–বাণিজ্যে ‘ম্যাজিক রতন’

গুলিস্তানের দুটি মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান নির্মাণ এবং বিক্রির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ।

ফরিদ উদ্দিন

দেড় বছর আগেও অস্ত্রধারী দুজন দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতেন তিনি। নগর ভবনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা তাঁর দাপটে সব সময় তটস্থ থাকতেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আড়ালে চলে যান। কয়েক মাস পর প্রকাশ্যে এলেও দেহরক্ষীদের আর সঙ্গে রাখছেন না। স্থানীয় বাসিন্দা ও নেতা–কর্মীদের কাছে তিনি ‘ম্যাজিক রতন’ নামে পরিচিত। গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন একটি বড় বিপণিবিতান (মার্কেট) থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান শুরুর পর আবারও আলোচনায় এসেছেন তিনি।

‘ম্যাজিক রতন’ নামে পরিচিত মানুষটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এন এন বিল্ডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়ক, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্যও। আগে ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ফেনীর সোনাগাজী থেকে ঢাকায় এসে আড়াই দশকের মধ্যেই বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ায় লোকজনের কাছে ‘ম্যাজিক রতন’ নামে পরিচিত কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারি একটি প্রকল্পের আট মাসের কাজ মাত্র ২৮ দিনে শেষ করায় প্রকল্পের লোকজন তাঁকে ‘ম্যাজিক রতন’ নাম দিয়েছে।

*সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান রয়েছে ৭৫৭টি *নির্মাণাধীন গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে ৪০০ অবৈধ দোকান তৈরি

এই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, গুলিস্তানে ডিএসসিসির মালিকানাধীন সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান বৈধ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে এই মার্কেটে অভিযান চালাচ্ছে ডিএসসিসি। এখানে ৭৫৭টি অবৈধ দোকান রয়েছে। অভিযানের প্রথম দিনই ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের বলেন, অবৈধ দোকান বৈধ করে দেওয়ার নাম করে তাঁদের কাছ থেকে কাউন্সিলর রতন ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. সাহাবুদ্দিন কয়েক লাখ টাকা করে নিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পাওয়ার পর সেদিন সন্ধ্যায় (১৭ ডিসেম্বর) কাউন্সিলর রতনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এতে বলা হয়, ‘আপনার (রতন) এলাকাধীন পুরান বাজার হকার্স মার্কেট/পোড়া মার্কেটসহ কয়েকটি মার্কেটে বর্তমান মেয়রের নাম ব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ গ্রহণ করেছেন।’ বিষয়টি অসদাচরণ বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৫ সালের এপ্রিলে প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন রতন। এখন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তখন সাহাবুদ্দিনের ক্ষমতার নেপথ্যে ছিলেন রতন। সাহাবুদ্দিন ও তাঁর অনুসারীরা মার্কেটের নিচ থেকে চারতলা পর্যন্ত শৌচাগারের ও লিফটের জায়গা অবৈধভাবে দোকান তৈরি করেন। এ ছাড়া চারতলা ভবনের ওপর অবৈধভাবে আরেক তলা বানিয়ে সেখানে ৩০৪টি দোকান তৈরির পর তা বিক্রি করে দেন। পাঁচতলায় নির্মিত প্রতিটি দোকান ৬ থেকে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর নিচ থেকে চারতলা পর্যন্ত তৈরি দোকানগুলো বিক্রি করা হয় প্রতিটি ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকায়।

সরকারি একটি প্রকল্পের আট মাসের কাজ মাত্র ২৮ দিনে শেষ করায় প্রকল্পের লোকজন ‘ম্যাজিক রতন’ নাম দিয়েছে।
ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ, ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর

সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত নকশার বাইরে অবৈধ দোকান বানিয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন ও তাঁর অনুসারীরা। আর অবৈধভাবে পাঁচতলা বানিয়েছেন কাউন্সিলর রতন। বেসমেন্টে (পার্কিংয়ের জায়গায়) থাকা তাঁর একটি দোকান দখলে নিয়ে ছয় বছর ধরে সাহাবুদ্দিন ভাড়া নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কেটের নিচতলার এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, একটি দোকান ৪২ লাখ টাকায় কিনেছিলেন। যুবলীগ নেতা সাহাবুদ্দিনের কথামতো তিন কিস্তিতে এই টাকা দিয়েছেন। তখন ৪২ লাখ টাকায় তাঁর কেনা দোকানটির বাজারমূল্য ছিল ন্যূনতম ১ কোটি টাকা। কাউন্সিলর রতন ও সাহাবুদ্দিনের ক্ষমতার যে দাপট ছিল, তাতে কখনো কেউ ভাবেনি দোকান উচ্ছেদ হবে।

অবৈধ দোকান তৈরির পর তা বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন। সেগুনবাগিচায় নিজ কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাঁকে বিপদে ফেলতে এসব মিথ্যা অভিযোগ করছে। এ সময় তিনি আরও বলেন, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করেছেন। তবে এখন অর্থকষ্টে আছেন বলে দাবি করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চেষ্টা করেও সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর দুটি মুঠোফোন নম্বর বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কেটে উচ্ছেদ শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁরা সাহাবুদ্দিনের খোঁজ পাচ্ছেন না।

এদিকে সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ছাড়াও গুলিস্তান এলাকায় আরেকটি মার্কেটে অবৈধ দোকান তৈরি করে তা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর রতনের বিরুদ্ধে। গত ২৯ অক্টোবর ডিএসসিসির মেয়রের কাছে এ–সংক্রান্ত একটি অভিযোগও দিয়েছেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার (পোড়া মার্কেট নামে পরিচিত) মালিক সমিতি লিখিত অভিযোগে বলেছে, নকশায় থাকা দোকানের আকার ছোট করে এবং প্রতি তলায় লিফট ও টয়লেটের জায়গা দখল করে ৪০০ অবৈধ দোকান তৈরি করা হয়েছে। এসব দোকানের মধ্যে ২০০টি দোকান ‘মেয়র কোটার’ কথা বলে বিক্রি করেছেন কাউন্সিলর রতন। এর মাধ্যমে তিনি ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে মালিক সমিতি।

২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ এসব দোকান বিক্রির টাকা কাউন্সিলর রতন ও সাহাবুদ্দিনেরা নিয়েছেন। ক্যাসিনো–বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটও এই টাকার ভাগ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।