দোকানের চেয়ে বারান্দার ভাড়া ৯গুণ

দোকানের সামনে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। গত শনিবার নিউমার্কেটের ভেতরে। ছবি: প্রথম আলো
দোকানের সামনে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। গত শনিবার নিউমার্কেটের ভেতরে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা নিউমার্কেটে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত একটি দোকানের প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ২২ টাকা। এই হিসাবে ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি দোকানের ভাড়া বাবদ সিটি করপোরেশনকে মাসে ৪ হাজার ৪০০ টাকা দেন দোকানমালিকেরা। অথচ দোকানের সামনের বারান্দায় দুজন হকার বসিয়েই মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করছেন তাঁরা, যা মূল দোকানের চেয়ে প্রায় ৯ গুণ বেশি।

নিউমার্কেটের ভেতর চলাচলের পথে হকার বসায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা। যত্রতত্র হকার বসায় মার্কেটটির পরিবেশও দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া হকারদের ডাকাডাকির কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন ক্রেতারা। এসব কারণে ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটের সুনাম রক্ষায় হকারমুক্ত নিউমার্কেট চান তাঁরা।

নিউমার্কেটের ভেতরের পরিবেশ ঘিঞ্জি হয়ে পড়লেও হকার ও দোকানমালিকদের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ ছাড়া চোখের সামনে হকারদের এমন দৌরাত্ম্য চলতে থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি। ফলে ক্রেতাদের চলাচলের পথে নিয়মিত পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসছেন হকাররা।

নিউমার্কেটের ভেতর হকার বসানোর পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন ব্যবসায়ী সমিতির একাধিক নেতা। একটি পক্ষ বলছে, নিউমার্কেটের দোকানে বেচাকেনা কম। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া এই মার্কেটে ক্রেতার উপস্থিত কম থাকে। ফলে যাঁরা সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে দোকান চালাচ্ছেন, মাস শেষে তাঁদের দোকানের বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ ওঠে না। তাই তাঁরা দোকানের সামনের জায়গা ও বারান্দায় হকার বসান। আরেকটি পক্ষ বলছে, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। এই মার্কেটে অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা বারান্দা ভাড়া না দিয়ে নিজেই দোকান চালান। অথচ তাঁদের দোকানের সামনেও হকার রয়েছে। মার্কেটের পরিবেশ বজায় রাখতে দোকানে বেচাকেনা হোক বা না হোক, মার্কেটে হকার ঢুকতে পারবেন না।

ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেটের পরিবেশের সঙ্গে হকার শব্দটা মানায় না। বরং এই মার্কেটে খোলামেলা উন্মুক্ত পরিবেশ থাকলে ক্রেতা বাড়বে। নিউমার্কেট তার প্রাণ ফিরে পাবে। তিনি বলেন, আগে মার্কেটের ভেতর হকার বসলে তাঁদের উচ্ছেদে অভিযান চালাত ডিএসসিসি ও নিউমার্কেট থানা-পুলিশ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তা হচ্ছে না। এখন প্রায় প্রতিটি দোকানের সামনেই হকার বসছেন। এ নিয়ে ব্যবসায়ী বা দোকানিদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তাই ডিএসসিসিকেই এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৫৪ সালে প্রায় ৩৫ একর জায়গার ওপর ত্রিভুজাকৃতির নিউমার্কেট ভবন নির্মাণ করা হয়। এর তিন দিকে সুউচ্চ মিনারের মতো ফটক রয়েছে। এখন মার্কেটটিতে বৈধ দোকানের সংখ্যা প্রায় ৫০০। এর অধিকাংশ দোকানের সামনে এক বা একাধিক হকার হরেক রকম পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন। এই হিসাবে হকারদের কাছ থেকে মাসে এক কোটি টাকা চাঁদা তোলেন দোকানিরা।

নিউমার্কেটের পশ্চিম ফটকসংলগ্ন রফিক ট্রেডার্স হার্ডওয়্যার মার্চেন্ট দোকান। ইউ আকৃতির এই দোকানের দুই পাশে পৃথক দুটি ফটক। এই দুই ফটকের সামনে মাচা পেতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দুজন হকার। উত্তর পাশে মানুষের চলাচলের পথে এক সারিতে বসেছেন আরও সাতজন হকার। তাঁদের প্রত্যেককে এই জায়গায় বসতে সহযোগিতা করেছেন রফিক ট্রেডার্সের মালিক আবদুল হালিম। বিনিময়ে ফটকের সামনের দুটি দোকান থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার ও এই সাতটি দোকান থেকে ১০ হাজার করে তিনি ভাড়া নেন বলে জানিয়েছেন হকাররা। তবে ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন আবদুল হালিম। তিনি বলেন, তাঁর দোকানের সামনে ও পাশে তিনি হকার বসাননি। তাঁরা ‘রাজনৈতিকভাবে’ বসছেন। তবে রাজনৈতিকভাবে বসার অর্থ কী সে ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

নিউমার্কেটের ১২ নম্বর দোকানের নাম কে জে ওয়ার্ল্ড। প্রায় ২০০ বর্গফুট আয়তনের এই দোকানের সামনে পৃথক দুটি মাচায় পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন দুই হকার। তাঁদের একজনের নাম শামীম। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়েই তাঁরা এখানে পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করেন। প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দেন তাঁরা। এই দোকানের মালিক নজরুল ইসলামকে দোকানে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক কাউছার হামিদ বলেন, দোকানে বেচাকেনা কম। তাই তাঁর মালিক দোকানের সামনের জায়গা হকারদের ভাড়া দিয়েছেন। এই টাকা দিয়ে দোকানের খরচ মেটানো হয়। একইভাবে ২৪২ নম্বর দোকান লিলি স্টোর, ২৪৪ নম্বর দোকান বরিশাল জুয়েলার্স, ৯২ নম্বর দোকান সোহেল সুজসহ মার্কেটের প্রায় প্রতিটি দোকানের সামনে হকার বসতে দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, প্রতিদিন এই মার্কেটের ভেতর শত শত হকার বসছেন। মাস শেষে এসব হকারের থেকে আদায় করা টাকার একটি অংশ ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম-পরিচয় তিনি দেননি।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। তবে এর ভেতর হকার বসার বিষয়টি তিনি অবগত রয়েছেন। শিগগির ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এই মার্কেট হকারমুক্ত করা হবে।