বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ববোধ, উদারতা আজ বেশি প্রয়োজন

মনীষী ও সমাজসংষ্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ছবি: সংগৃহীত

মূল নাম ঈশ্বরচন্দ্র। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। কিন্তু এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে তা জুড়ে আছে, মনে হয় পুরোটাই তাঁর নাম। ‘দয়ারসাগর’ বলেও পরিচিত ছিলেন। অর্থ-সম্পদে দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু দাতা ছিলেন অনেক বড় মাপের। ভাষাগঠন, সমাজসংস্কার, নারীশিক্ষার প্রচার এসব বহুমুখী কর্মময়তা তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। তবে এসবের চেয়েও বড় ছিল তাঁর মনুষ্যত্ববোধ। মানবিক মহিমায় তিনি ছিলেন অনন্য।

উনিশ শতকের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও গদ্যকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে উঠে এল তাঁর কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের এসব বিষয়। আজ রোববার সকালে বাংলা একাডেমি এই আয়োজন করে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান।

করোনাকালে দর্শক-শ্রোতা ছিল সামান্যই। তাঁদের স্বাগত জানিয়ে মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেন, ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল বিদ্যাসাগরের জন্মবার্ষিকী। শৈশবে বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আমাদের যে পরিচয় শুরু হয়, তা এক জীবনে শেষ হওয়ার নয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলা একাডেমি বিদ্যাসাগর স্মারক গ্রন্থ এবং তাঁর রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে।

কবিগুরুর দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর ছিলেন যথার্থ মানুষ। প্রকৃত মনুষ্যত্বের প্রকাশ ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি তাঁর এই মানবিক চেতনা কেবল চিন্তা বা লেখার ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং সেটি তাঁর সব কাজে প্রয়োগ করেছেন। সমাজের কোনো বাধা, সংস্কার, ভয়—কিছুই গ্রাহ্য না করে যুক্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন।
বেগম আকতার কামাল, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একক বক্তৃতার মূল ভাবনা ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়নে কেমন ছিলেন বিদ্যাসাগর। শিরোনাম ‘রবীন্দ্রদৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের চরিত্রাখ্যান: আপন হতে বাহির হয়ে’। বেগম আকতার কামাল দীর্ঘ আলোচনায় তুলে ধরলেন এ–সংশ্লিষ্ট নানা প্রসঙ্গ। বিদ্যাসাগরের দুটো চরিত্রাখ্যান রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাতে তিনি ধর্ম–বর্ণ–জাতিভেদের ঊর্ধ্বে বিদ্যাসাগরের মানবহিতৈষী দিকেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। কবিগুরুর দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর ছিলেন যথার্থ মানুষ। প্রকৃত মনুষ্যত্বের প্রকাশ ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি তাঁর এই মানবিক চেতনা কেবল চিন্তা বা লেখার ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং সেটি তাঁর সব কাজে প্রয়োগ করেছেন। সমাজের কোনো বাধা, সংস্কার, ভয়—কিছুই গ্রাহ্য না করে যুক্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন। এমনকি নগর কলকাতার তথাকথিত সভ্য ও রেনেসাঁর ধারকবাহকদের নিন্দামন্দ, বিদ্রূপ, আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ জীবনে কলকাতা ছেড়ে ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পল্লিতে গিয়ে থেকেছেন। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে একটুও বিচ্যুত হননি।

আলোচক দেখিয়ে দিলেন, বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরোয়নি। এখন সময়টা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সহিংসতা, আত্মস্বার্থে অতিমাত্রায় নিমজ্জিত হওয়া, ভোগবিলাসে মত্ত থেকে পরিবেশ বিনাশ করা ও বিপুল বাণিজ্যিকীকরণের। এমন সময়ে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ববোধ, দয়া ও উদারতা আরও বেশি প্রয়োজন।

একক বক্তৃতায় ভাষাসংস্কার, পাঠ্যপুস্তক রচনা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারীর শিক্ষা, বিধবাবিবাহ প্রচলনসহ সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অসামান্য ভূমিকা এবং ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনাও উঠে আসে। যেমন এখন অবধি বাংলা ভাষা যে কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা বিদ্যাসাগরেরই তৈরি করা। তিনি অলংকারযুক্ত গদ্য যেমন লিখেছেন, তেমনি পত্রপত্রিকার জন্য বিধবাবিবাহ ও অন্যান্য যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে মৌখিক ভাষার ব্যবহার করে সহজ গদ্যও লিখেছেন। সেই লেখায় ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের দিনের খবরের কাগজের ভাষা। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও বর্বরতা থেকে উদ্ধার করে বাংলা ভাষাকে আধুনিক করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র।

আলোচনা শেষ হয়েছিল বিদ্যাসাগর এখনো প্রাসঙ্গিক কি না, এই প্রসঙ্গ তুলে। আলোচক দেখিয়ে দিলেন, বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরোয়নি। এখন সময়টা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সহিংসতা, আত্মস্বার্থে অতিমাত্রায় নিমজ্জিত হওয়া, ভোগবিলাসে মত্ত থেকে পরিবেশ বিনাশ করা ও বিপুল বাণিজ্যিকীকরণের। এমন সময়ে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ববোধ, দয়া ও উদারতা আরও বেশি প্রয়োজন।

বিদ্যাসাগর ধর্মের ভেতরে ঢুকেই যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপের জ্ঞান তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জীবনাচারে তা অনুকরণ করেননি।
শামসুজ্জামান খান, সভাপতি, বাংলা একাডেমি

অনুষ্ঠানের সভাপতি শামসুজ্জামান খান বলেন, বিদ্যাসাগর ধর্মের ভেতরে ঢুকেই যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপের জ্ঞান তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জীবনাচারে তা অনুকরণ করেননি। খাটো ধুতি-মোটা চাদর আর চটি পায়ে খুবই সাধারণভাবে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল তাঁর পর্বতসম অটল। ছেলেকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর স্ত্রী ও মা–বাবা আসেননি। কিন্তু তাতে তিনি বিচলিত হননি। বলেছেন, যা সত্য বলে বিবেচনা করেছেন, তা–ই করেছেন তিনি। নীতির প্রশ্নে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করেছেন। অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, অথচ অকাতরে দান করেছেন। নিজের সংসারের কথা ভাবেননি। দানের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করেননি। বিলেতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অর্থকষ্টে পড়লে তাঁকে টাকা পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরই। কলকাতার যে রেনেসাঁ শোষিত কৃষকের কথা, নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবেনি, সেই তথাকথিত রেনেসাঁর সঙ্গে তিনি থাকতে পারেননি। এভাবেই শুধু ভাষা ও শিক্ষা নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজবিপ্লবের প্রধান ঋত্বিক।