নিচে ‘মধু’ আর ময়লা

চার কিলোমিটারে অবৈধ স্থাপনা থেকে মাসে চাঁদা তোলা হয় ৬ লাখ টাকা। পাঁচ কিলোমিটারে আস্তাকুঁড়।

  • সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়।

  • ২০১৭ সালে জায়গাগুলো জাল দিয়ে আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ সিটি।

  • হকার পুনর্বাসন, পথশিশুদের জন্য বরাদ্দের পরামর্শ ছিল নগর–পরিকল্পনাবিদদের।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের নিচের বিভিন্ন অংশ দখল করে ছোটখাটো দোকানঘরসহ খাবারের হোটেল করতে দিয়েছে প্রভাবশালী মহল। বিনিময়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে দিতে হয় টাকা। সম্প্রতি উড়ালসড়কের নিচে গুলিস্তান অংশেছবি: নাজমুস সাকিব

রাজধানীর সবচেয়ে বড় উড়ালসড়ক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার চালু হয়েছে সাত বছর হলো। এত দিনেও উড়ালসড়কটির নিচে সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

এই উড়ালসড়কের সাড়ে ১১ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৪ কিলোমিটারে ‘মধু’ খুঁজে পেয়েছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাঁরা অবৈধভাবে দোকান ও নানা ধরনের স্থাপনা বসিয়ে চাঁদা ওঠাচ্ছেন। মোটামুটি ৯টি স্থানের ১৪৮টি দোকান, গ্যারেজ ও পার্কিং থেকে যে চাঁদা তোলা হয়, তা পরিমাণে দাঁড়ায় মাসে প্রায় ৬ লাখ টাকা। আর প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটারে ময়লার ভাগাড় ও ভবঘুরেদের বাস। কিছু অংশে ট্রাফিক পুলিশ বক্স এবং সিটি করপোরেশনের ময়লা স্থানান্তরের জায়গা (এসটিএস) ও গণশৌচাগার করা হয়েছে।

উড়ালসড়কের নিচের এই অবস্থা নিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। জয়কালী মন্দির এলাকার বাসিন্দা রাসেল আহমেদ বলেন, উড়ালসড়কের সুবিধা রাজধানীর মানুষ পাচ্ছে। তবে তাঁদের এলাকায় রাস্তা সরু হয়ে গেছে। সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু উড়ালসড়কের নিচে এভাবে ভাগাড় কেন?’

চাঁদা তোলেন কে, কত

মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে কাজলা পর্যন্ত বিস্তৃত। কাজলা এলাকায় উড়ালসড়কের নিচে কাঁচাবাজারে সবজি ও মাছ কাটার দোকান আছে প্রায় ৪০টি। হারাধন নামের এক দোকানি বলেন, প্রতিটি মাছ কাটার দোকানে দিনে ১৫০ টাকা করে দিতে হয়। পাশের কাঁচাবাজারের প্রতিটি সবজির দোকান থেকে দিনে তোলা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ওঠে।

কাজলা এলাকায় উড়ালসড়কের নিচে সাত বছর ধরে ভ্যানের গ্যারেজ চালান নুর হোসেন। গ্যারেজে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর সহকারী জামাল হোসেন বলেন, এখানে প্রায় ৭০টি ভ্যান রাখা হয়। মাসে প্রতিটি ভ্যানের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় ৫০০ টাকা। এ হিসেবে মাসে ওঠে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা।

জানা যায়, নূর হোসেন যাত্রাবাড়ী থানা কৃষক লীগের নেতা। সহকারী জামালের কাছে তাঁর মুঠোফোন নম্বর চাইলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানান।

জয়কালী মন্দিরের সামনের উড়ালসড়কের নিচে বেশ কিছু চা ও একটি মুরগির দোকান দেখা যায়। মুরগির দোকানি বলেন, বছরখানেক হলো দক্ষিণ সিটির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ ওরফে মান্নাফি তাঁকে দোকানটি ভাড়া দিয়েছেন। কত ভাড়া, তা তিনি বলতে চাননি। তবে পাশের এক দোকানি জানান, মাসে ভাড়া ২০ হাজার টাকা। আর চায়ের দোকানকে দিনে ১৫০ টাকা করে দিতে হয়। ৯টি চায়ের দোকানকে মাসে ৪০ হাজার টাকার মতো দিতে হয়। ইমন নামের এক ব্যক্তি এ চাঁদা ওঠান। তিনি কার পক্ষ থেকে চাঁদা তোলেন, তা দোকানি জানাতে পারেননি।

সম্প্রতি গিয়ে এই চায়ের দোকানগুলোর ঠিক পাশেই একটি খালি জায়গা পরিষ্কার করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেন, রাতে সেখানে মুরগির পাইকারি বাজার বসে। প্রতি রাতে সেখানে ৯০ থেকে ১০০টি মুরগিবাহী ট্রাক আসে। ট্রাকপ্রতি ৭০ টাকা করে চাঁদা তোলেন চার ব্যক্তি, যাঁরা স্থানীয় কাউন্সিলরের লোক বলে পরিচিত। চারজনের দুজন হলেন পিয়াস ও সজীব। তাঁরা জানান, টাকা উঠিয়ে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে জমা দেন তাঁরা। দোকান ও ট্রাক মিলিয়ে মাসে সোয়া দুই লাখ টাকার মতো ওঠে।

এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ ওরফে মান্নাফি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব মিথ্যা। আমি এলাকার কাউন্সিলর বলে লোকে মনে করে চাঁদা আমি ওঠাই। কিন্তু আমি এর সঙ্গে জড়িত না। আমার নামে চাঁদাবাজি হলে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।’

গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের সামনে উড়ালসড়কের নিচের জায়গায় দোকান বসান হকাররা। তাঁরা জানান, দোকানগুলো থেকে দিনে ৩০ টাকা করে মাসে লাখখানেক টাকা তোলা হয়। এখানে বেশ কয়েকজন টাকা তোলার কাজটি করেন। তাঁদের একজন খাজা আহমেদ। মুঠোফোনে খাজা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদা তোলার সঙ্গে তিনি একা নন, নেতারাও জড়িত। তবে নেতার নাম জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে আর ফোন ধরেননি।

বঙ্গবাজার থেকে চানখাঁরপুল পর্যন্ত উড়ালসড়কের নিচে প্রায় ৪৫টি ঘোড়া রাখা হয়। ওই এলাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায়। ঘোড়ার মল-মূত্রে রাস্তা নোংরা হয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঘোড়ার মালিক বলেন, তাঁরা কাউকে নিয়মিত কোনো টাকা দেন না। তবে মাঝেমধ্যে পুলিশের কেউ কেউ ‘ঝামেলা করলে’ তাঁদের চা-পানের জন্য এককালীন ৮-১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

উড়ালসড়কের যাত্রাবাড়ী-দোলাইরপার যাওয়ার অংশে নিচে চা, বিভিন্ন সামগ্রী ও আসবাবের দোকান দেখা যায়। একই চিত্র দেখা যায় সায়েদাবাদ, টিকাটুলী, জয়কালী মন্দির, গুলিস্তানের উড়ালসড়কের নিচে। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি উড়ালসড়কটির নিচে ছয়টি ময়লা স্থানান্তরের জায়গা, চারটি গণশৌচাগার ও ছয়টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স করেছে। সায়েদাবাদ এলাকায় একটা অংশ বাস রাখার জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা যা ছিল

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, উড়ালসড়কের নিচে উঁচু বিভাজকে সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়। তবে সে পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি। জায়গাগুলো ভাগাড়ে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে ২০১৭ সালে জাল দিয়ে আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ সিটি। তবে কোথাও কোথাও জাল কেটে ভেতরটা দখলে নেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও জালের ওপর দিয়ে ময়লা ফেলে ভাগাড় তৈরি করা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে যখন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন দায়িত্বে ছিলেন, তখন বেশ কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি উড়ালসড়কের নিচে পরিকল্পিতভাবে হকার পুনর্বাসন, পথশিশুদের জন্য বরাদ্দ ও সৌন্দর্যবর্ধনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালের ৩০ জুন আমি মেয়রের সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবটি দিই। তিনি সব শুনে প্রস্তাবনায় কিছু সংশোধনী দেন। পরে আমি তা সংশোধন করে জমা দিই। তবে দুঃখজনক যে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তাই এখন উড়ালসড়কের নিচের অংশ দখল ও ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।’

সাঈদ খোকনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ইকবাল হাবিবের সঙ্গে অনেক কাজ করা হয়েছে। এমন প্রস্তাবের কথা এখন মনে নেই। তবে এমন প্রস্তাব যদি তিনি দেন, তা আসলেই খুব ভালো ছিল।’

উড়ালসড়কের নিচের অংশ বেদখল আর ভাগাড় হয়েই থাকবে? এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ডিএসসিসি প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘উড়ালসড়কের নিচের জায়গা দখল হলেই আমরা উচ্ছেদ করে দিই। তবে সম্প্রতি আমরা খাল পরিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ওদিকে নজর কম দেওয়া হয়েছে। তবে খুব শিগগির উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।’

উচ্ছেদই কি সমাধান—জানতে চাইলে রাসেল সাবরিন বলেন, ভবিষ্যতে কী করা হবে, তা মেয়র বা প্রকৌশল বিভাগ সিদ্ধান্ত নেবে।