পত্রিকার পাতায় 'দ্যাশের খবর' খুঁজছেন লুৎফর রহমান

নিজের পরিবার, সন্তানদের কথা তাতে লেখা থাকবে না সেটা জেনেও পাতা ওলটাচ্ছিলেন লুৎফর রহমান। ছবি: লেখক
নিজের পরিবার, সন্তানদের কথা তাতে লেখা থাকবে না সেটা জেনেও পাতা ওলটাচ্ছিলেন লুৎফর রহমান। ছবি: লেখক

লকডাউনের আওতায় থাকা মোহাম্মদপুরের আদাবর ৭ নম্বর সড়কে মধ্য দুপুরে একজনকে সংবাদপত্র পড়তে দেখে এগিয়ে গেলাম। করোনাভাইরাসের ভয়ে যখন মানুষ পত্রিকা পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, তখন পত্রিকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন জলজ্যান্ত মানুষ পত্রিকা পড়ছেন, এর চেয়ে অভাবনীয় দৃশ্য আর কী হতে পারে!

কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী পড়েন?’ শুনে একটু হকচকিত হয়ে গেলেন তিনি। পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘করোনার খবর পড়ি, কাকা। দ্যাশের খবর দেখি।’ বাঙালির ভাবনায় দেশ মানে রাষ্ট্র নয়। দেশ মানে জন্মভূমি, গ্রাম, জনপদ—যেখানে মানুষ জন্মায়, বেড়ে ওঠে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মারাও যায়। বাঙালির ভাবনায় দেশ মানে মাটি, মানুষ, শস্য, ফল-ফুল, পরিবার, স্বজন, দেশ মানে ঘরে ফেরার তাড়া, দেশ মানে স্মৃতি। দেশ মানে যেখানে ছড়িয়ে থাকে তার শিকড়। সেই শিকড় যখন সংক্রমিত এক অদৃশ্য ভাইরাসে, তখন যত দূরেই থাকুক না কেন, বাঙালি ‘দ্যাশের খবর’ নেবেই। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি দেখে একটু যেন স্বস্তি পেলেন পত্রিকা পাঠক। আবার মুখ ফেরালেন পত্রিকার পাতায়। এ পাতা, সে পাতা খুঁজতে থাকলেন গভীর মনোযোগে।

দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। চলছে লকডাউন। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার আদাবর, শেখেরটেকও লকডাউনের আওতায়। ফলে মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। এই এলাকার যেসব গলিতে করোনার রোগী পাওয়া গেছে, সেগুলো মানুষের যাতায়াত বন্ধ করার জন্য বাঁশ দিয়ে আটকানো। এ রকম এক পরিস্থিতিতে আদাবর ৭ নম্বর সড়কের মসজিদের পাশের একটি সংবাদপত্র বিক্রির দোকানের সামনে পাওয়া গেল লুৎফর রহমানকে। তিনি রিকশা চালান। মধ্য দুপুরে রিকশা থামিয়ে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা সংবাদপত্র পড়ছিলেন তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে।

আদাবর ৭ নম্বর সড়কের মসজিদের পাশের একটি সংবাদপত্র বিক্রির দোকানের সামনে পাওয়া গেল লুৎফর রহমানকে। মধ্য দুপুরে রিকশা থামিয়ে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা সংবাদপত্র পড়ছিলেন তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে। ছবি: লেখক
আদাবর ৭ নম্বর সড়কের মসজিদের পাশের একটি সংবাদপত্র বিক্রির দোকানের সামনে পাওয়া গেল লুৎফর রহমানকে। মধ্য দুপুরে রিকশা থামিয়ে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা সংবাদপত্র পড়ছিলেন তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে। ছবি: লেখক

লুৎফর রহমানের বাড়ি গাইবান্ধা। তিনি শুনেছেন, সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের রোগী পাওয়া গেছে। শনাক্ত রোগীদের কেউ মারাও গেছে। মৃত্যুর সংবাদে উদ্বিগ্ন লুৎফর রহমান জানালেন, গাইবান্ধায় আছেন তাঁর সন্তানেরা, আছেন স্ত্রী। তাঁরা কি সুস্থ আছেন? পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বিড়বিড় করে গাইবান্ধার আঞ্চলিক উচ্চারণে তিনি জানালেন, মোবাইলে কথা হয়েছে। এখনো ভালো আছে তারা। পরিবারের কথা উঠতেই গাঢ় বিষণ্নতা ছুঁয়ে গেল লুৎফর রহমানকে। যানবাহন বন্ধ বলে যেতে পারছেন না তাদের কাছে। এত দূর থেকে পরিবারের খোঁজখবর রাখা যায় না ঠিকমতো, তাই চিন্তা বাড়ে। আবার চিন্তা করেওবা লাভ কী? তাই এই লকডাউনেও রিকশা চালান লুৎফর রহমান। টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন। সে চেষ্টার জন্যই এসেছিলেন আদাবর। বেশির ভাগ রিকশাচালকের মতো তিনিও প্রায় রিক্ত হাতেই ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন নিজের ঝুপড়িতে। পথে পত্রিকার দোকানে ঝুলিয়ে রাখা পত্রিকা দেখে দাঁড়িয়েছিলেন, ‘দ্যাশের খবর’ জানার জন্য। নিজের পরিবার, সন্তানদের কথা তাতে লেখা থাকবে না, সেটা জেনেও পাতা ওলটাচ্ছিলেন লুৎফর রহমান।

অল্প কিছু লেখাপড়া করেছেন লুৎফর রহমান, তাতে পত্রিকা পড়ার কাজ চলে যায়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ আর প্রতিদিনের মৃত্যুসংবাদ বিচলিত করে পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মানুষটিকে। নিজের এলাকা সংক্রমিত হয়েছে, তাই দুশ্চিন্তাটা একটু বেশি। কিন্তু সংবাদ পেয়েছেন মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক আর ধর্মীয় পরিচয় ভুলে। সংবাদ পড়ে আর শুনে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাবতে পারছেন না তিনি। এই মুহূর্তে তাঁর একটাই চাওয়া, দ্যাশের মানুষ বাঁচুক, বাংলাদেশ মুক্তি পাক, সারা বিশ্বই মুক্তি পাক করোনা থেকে।