পানির উৎস নিয়ে ওয়াসার তথ্যে ‘শুভংকরের ফাঁকি’

এখনো ৭৫ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। সুফল মিলছে না নদীর পানি শোধন প্রকল্পের।

  • ঢাকায় ৯২৩টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তোলা হয়।

  • একটি গভীর নলকূপ বসাতে ১০ বছর আগে ব্যয় হতো ৪০-৫০ লাখ টাকা। এখন ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি।

নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটির কর্তৃপক্ষের দাবি, বর্তমানে ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৬৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎসের (মাটির নিচের)। বাকি ৩৫ শতাংশ ভূ-উপরিভাগের। তবে ওয়াসার নথি বলছে, এখনো প্রায় ৭৫ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ ও শোধনাগার থেকে দৈনিক উত্তোলিত পানির হিসাব প্রস্তুত করে সিস্টেম অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল বিভাগ। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসের ছয় দিনের দৈনিক পানি উৎপাদনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দৈনিক গড়ে ৭৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার ১০টি অঞ্চলে অবস্থিত গভীর নলকূপ থেকে সিংহভাগ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। সাভারের ভাকুর্তায় অবস্থিত গভীর নলকূপ প্রকল্প থেকে দৈনিক গড়ে ৯ থেকে ১১ কোটি লিটার পানি আসে। ওয়াসার ভূ-উপরিভাগের উৎসের মধ্যে রয়েছে ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কস, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ১ ও ২ এবং পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প।

ওয়াসার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাভারের ভাকুর্তায় উৎপাদিত পানি পরিশোধন করে সরবরাহ করা হয়। পরিশোধনের ফলে এই প্রকল্পের পানির উৎপাদন খরচ ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে অনেক বেশি হয়। ওয়াসা এই প্রকল্পের উৎপাদিত পানিকে ভূ-উপরিস্থ উৎস হিসেবে ধরে।

দৈনিক পানি উত্তোলনের তথ্য অনুযায়ী, দুই বছর আগে উদ্বোধন হওয়া পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে বর্তমানে গড়ে ২৪ থেকে ২৮ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এই শোধনাগারের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ৪৫ কোটি লিটার। কিন্তু এই শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে সরবরাহের পাইপলাইন (নেটওয়ার্ক) স্থাপন করেনি ঢাকা ওয়াসা। এ কারণে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই অব্যবহৃত থাকছে। অথচ চীন সরকারের কাছ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এই পদ্মা–যশলদিয়া প্রকল্পটি করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা ২০০৯ সাল থেকে মাটির নিচের পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর কথা বলে আসছে। ওই বছর ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেছিলেন, গভীর নলকূপ কম বসিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। ২০১০ সালে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।

এক যুগ আগে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮০ শতাংশ ছিল ভূগর্ভস্থ উৎসের। আর ২০ শতাংশ ছিল ভূ-উপরিস্থ পানি। ঘুরে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে তাকসিম এ খান ভূ-উপরিস্থ পানির উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। এটি অর্জনে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করেছিল সংস্থাটি।

তবে বাস্তব চিত্র পুরো উল্টো। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ ছিল ৫১৯টি। এরপর থেকে প্রতিবছরই নতুন নলকূপ বসানো হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপের সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বসানো ৯২৩টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ওয়াসার পানি তোলা হয়। এই বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিনরাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে।

ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ঢাকায় পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। আর এ কারণে পানি তোলার খরচ দিন দিন বাড়ছে। ১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০-৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান গত ৫ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘নগরবাসীর চাহিদা—ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা’ শীর্ষক সংলাপে বলেন, ২০২৩ সালের মধ্যে ৭০ ভাগ ভূ-উপরিভাগের উৎস থেকে পানি উৎপাদন করা হবে। বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করায় পানির উৎসের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়ার সুযোগ হয়নি।

নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর জন্য নেওয়া ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পগুলোর ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিভাগের পানি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি।

যেমন মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে নেওয়া প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। তিন দফায় এই প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে, খরচ বেড়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে, সেটি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এর আগে পদ্মা–যশলদিয়া প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি।

ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের পরিণতি ভয়ানক হতে পারে বলে মনে করেন নগর গবেষণা সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ওয়াসা দাবি করলেও আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার ৭০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে না।