পুলিশের তদন্তেও উঠে এল তিতাসের অবহেলা

পুলিশ সদর দপ্তরের করা কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দু–এক দিনের মধ্যে জমা দেওয়া হবে।

রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ধসে যাওয়া একটি তিন তলা ভবনের পেছনের অংশ।ফাইল ছবি

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তদন্তে মগবাজারের ওই তিনতলা বাড়ির নিচতলায় বেঙ্গল মিটের জেনারেটর রুমের নিচ দিয়ে তিতাসের একটি পরিত্যক্ত গ্যাসলাইন পাওয়া গেছে। যাতে গ্যাস সরবরাহ ছিল। ওই লাইনের ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাস বেঙ্গল মিটের একটি কক্ষে (চিলার রুমে) জমা হয়। সেখানে কোনো কারণে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ (স্পার্ক) থেকে সেখানে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্তে এসেছে।

পুলিশের সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির সভাপতি হলেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের তদন্ত কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হয়েছে। শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সেটা দু-এক দিনের মধ্যে জমা দেওয়া হতে পারে।’

গত ২৭ জুন বিস্ফোরণের পর থেকেই তিতাস কর্তৃপক্ষ দাবি করে আসছিল ওই বাড়িতে কোনো গ্যাস সংযোগ ছিল না। সেখানে গ্যাসের যে পাইপলাইন রয়েছে, সেটা সচল নয়। কিন্তু এ ঘটনায় করা পুলিশের করা কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের তদন্তে এসেছে, সাত বছর আগে ওই বাড়ির অবৈধ গ্যাস সংযোগ রাইজার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল তিতাস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই লাইনে গ্যাসের সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করেনি। বরং অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়। ওই পাইপলাইনটিতে ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্র থেকে গ্যাস প্রথমে জেনারেটর রুমে যায়। সেখান থেকে চিলার রুমে গিয়ে গ্যাস জমে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের হেড অব কমার্শিয়াল আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিলার রুম সাধারণত বন্ধ থাকে। সেখানে পণ্য সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে কীভাবে গ্যাস জমা হয়েছে এবং বিস্ফোরণ হয়েছে, এটা আমরা বুঝতে পারছি না।’

পুলিশের তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিতাসের মূল লাইন থেকে অবৈধ সংযোগটি কোনাকুনিভাবে বেঙ্গল মিটের জেনারেটর রুমকে অতিক্রম করে সেটি ওপরের দিকে উঠেছে। পাইপের উপরের দিকের দৃশ্যমান ওই অংশটিতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্ন করা হলেও পাইপলাইনটি রহস্যজনক কারণে অপসারণ করা হয়নি। বিচ্ছিন্ন অংশের আগ পর্যন্ত গ্যাসের লাইনটি সচল ছিল।

তদন্ত কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হয়েছে। শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সেটা দু-এক দিনের মধ্যে জমা দেওয়া হতে পারে।
মো. আসাদুজ্জামান, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহর সঙ্গে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। ফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

গত ২৭ জুন সন্ধ্যার পর ওই বাড়ির নিচতলায় বিস্ফোরণের ঘটে। এতে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক। বিস্ফোরণে আশপাশের অন্তত সাতটি ভবনের কাচ উড়ে যায়। রাস্তায় থাকা তিনটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ঘটনায় পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা ছয়টি তদন্ত কমিটি করেছে। এর মধ্যে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের করা কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই দুই কমিটি এই ঘটনার জন্য কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে দায়ী করেনি। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে জমে থাকা গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও সেই গ্যাসের উৎস সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।

পেট্রোবাংলার কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা না দিলেও তাঁদের তদন্তেও তিতাসের লাইনের ছিদ্র থেকেই গ্যাস জমার বিষয়টি এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের পয়োনিষ্কাশন লাইনের কাজ করার সময় সেখানে থাকা গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র হয়। সেখান থেকে গ্যাস বের হয়ে ওই বাড়ির নিচতলায় শরমা হাউসের ভেতরে জমা হয়, যা থেকে বিস্ফোরণ ঘটে।

এর বাইরে বিস্ফোরক পরিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কমিটি এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বিইআরসির তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির সদস্য (জ্বালানি) মকবুল–ই–ইলাহি চৌধুরী। আর বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাদের তদন্ত শেষ করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।

এ ছাড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে গত ২৯ জুন রমনা থানায় মামলা করে পুলিশ। মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিটিটিসি। মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ ঘটনায় করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন। এতে যাদের সম্পৃক্ততা আসবে, মামলার তদন্তে সেটাকে আমলে নিয়ে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে।