প্রাণ ফিরে পেয়েছে লালবাগ দুর্গ জাদুঘর

লালবাগ দুর্গের ভেতরের পরিবেশ। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার লালবাগেছবি: প্রথম আলো

টিকিট কাউন্টারের সামনে মাঝারি লম্বা সারি। সেই সারি অতিক্রম করে মূল ফটক পর্যন্ত পৌঁছাতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগল না। মূল ফটক দিয়ে ঢোকার সময় শোনা গেল, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা বারবার মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই একদম অন্য দৃশ্য। বাইরের যান্ত্রিক পৃথিবীকে যেন ছুটি দিয়ে ভেতরে বসেছে ফুলের মেলা। আর সেই ফুলের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

এ দৃশ্য ঢাকার লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের গত বৃহস্পতিবারের। পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত মোগল স্থাপত্য নিদর্শনের সাক্ষী হয়ে থাকা এ দুর্গ লালবাগ কেল্লা নামেই বেশি পরিচিত।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বাংলার সুবাদার থাকার সময় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহ ১৬৭৮ সালে লালবাগ দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তবে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই আওরঙ্গজেব তাঁর ছেলেকে দিল্লি ডেকে পাঠান। পরে সতেরো শতকে সুবাদার শায়েস্তা খানের বাসভবন হিসেবে এ দুর্গ ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে থাকা অবস্থায়ই শায়েস্তা খানের মেয়ে পরী বিবির মৃত্যু হয়। এই দুর্গে পরী বিবিসহ কয়েকজনের সমাধি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে জাদুঘর।

বাংলাদেশের, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে লালবাগ দুর্গ অন্যতম। এখানে সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আসা-যাওয়া থাকে। সাপ্তাহিক ছুটিসহ বছরের অন্যান্য ছুটির দিনগুলোয় এ দুর্গ জাদুঘর যেন জনারণ্যে পরিণত হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারির থাবায় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। এরপর ১৮ মার্চ দেশের সব প্রত্নস্থল ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধ থাকার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসব প্রত্নস্থল ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর আবার খুলে দেওয়া হয়। প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে এসব স্থাপনা।

দুর্গ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে দিনে তিন থেকে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী আসছেন লালবাগ দুর্গ জাদুঘরে। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোসহ সরকারি ছুটির দিনগুলোয় দর্শনার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হালিমা আফরোজ প্রথম আলোকে গতকাল শুক্রবার বলেন, কোনো কোনো ছুটির দিনে এই সংখ্যাও পার করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আগামী দিনগুলোয় দর্শনার্থী আরও বাড়বে।’

আমরা মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দিই না বলে অনেকেই বাইরে থেকে মাস্ক কিনছেন। তারপর ঢুকেই মাস্ক খুলে ফেলছেন। মাস্ক পরতে বললে কেউ কেউ বাজে আচরণও করেন কর্মীদের সঙ্গে।
হালিমা আফরোজ, কাস্টডিয়ান, লালবাগ দুর্গ জাদুঘর

বৃহস্পতিবার বিকেলে দেখা গেল, অনেক মানুষই পরিবার নিয়ে লালবাগ দুর্গ জাদুঘরে বেড়াতে এসেছেন। মূল জাদুঘরের চেয়ে বেশির ভাগের আগ্রহ ফুলের বাগানগুলোর দিকে। সেখানেই সবুজ ঘাসের ওপর বসে অনেককেই গল্প-আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা গেল। অনেকে আবার দুর্গের শেষ প্রান্তে উঁচু ঢিবির ওপর উঠে পুরো কেল্লার দৃশ্য উপভোগ করছেন, ছবি তুলছেন। অনেকে আবার ভিড় করেছেন কেল্লার শুকিয়ে যাওয়া পুকুরটার প্রান্তে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন লালবাগের বাসিন্দা আবদুল খালেক। অফিস ছুটির পর শিশুসন্তানের ঘোরাঘুরির আবদার মেটাতে পরিবার নিয়ে এসেছেন লালবাগ দুর্গ জাদুঘরে। তিনি বললেন, করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অন্য সব শিশুর মতো তাঁর সন্তানও ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। তাই ইদানীং সুযোগ পেলেই বাসার কাছের এ দুর্গে চলে আসেন পরিবার নিয়ে। তিনি বলেন, ‘মহামারি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও জাদুঘরের মতো এই দুর্গ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল। তবে বেকায়দায় পড়েছিলাম আমরা। বিশেষ করে, বাচ্চাটার জন্য যেন দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। স্কুল বন্ধ, কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। বিনোদন বলতে কেবল টেলিভিশন আর মোবাইল ফোন।’

আবদুল খালেকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কানে ভেসে এল, কে যেন চিৎকার করছেন, ‘ফুল ছিঁড়বেন না, ফুল ছিঁড়বেন না।’ একজনকে দেখা গেল, দ্রুত একদল দর্শনার্থীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পরে জানা গেল, তিনি লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের বাগান পরিচর্যাকারী। নাম আনোয়ার হোসেন। করোনার সময় জাদুঘর বন্ধ থাকাকালে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, এই জাদুঘরে এমন নিস্তব্ধতা তিনি দেখেননি কখনো।

আনোয়ার হোসেন লালবাগ দুর্গ জাদুঘরে কাজ করছেন ২৬ বছর হলো। থাকেন দুর্গের কাছেই। তিনি জানালেন, গত সেপ্টেম্বরে দুর্গের দরজা আবার দর্শনার্থীদের জন্য খুলে যায়। এর পরপরই প্রাণ ফিরে পায় এ দুর্গ। তিনি বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) কী দেখছেন। কাল (শুক্রবার) আসলে দেখতেন, ১০ গুণ বেশি মানুষ আসব। পা রাখার জায়গা থাকব না।’ তবে কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই আনোয়ার বললেন, ‘মানুষ ঘুরতে আসে, ভালো লাগে। কিন্তু অনেকেই ফুল ছিঁড়ে। এটা তো ঠিক না।’

লালবাগ দুর্গের ভেতরের পরিবেশ। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার লালবাগে
ছবি: প্রথম আলো

মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে। আর সেই উল্টো পিঠের দর্শন পাওয়া যায় লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের মূল ফটক থেকে ভেতরে ঢোকার কিছু পরই। বেশির ভাগ দর্শনার্থী মাস্ক পরে দুর্গে ঢুকলেও পরী বিবির সমাধিসৌধ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই খুলে ফেলছেন তা। এ নিয়ে বিরক্ত আনোয়ার বললেন, ‘মাস্ক পরার কথা বলতে গেলেই মানুষ কেমন যেন করে। বলে, পরিবার নিয়ে আসছি, মাস্ক পরব কেন?’

আনোয়ারের কথার সত্যতা পাওয়া গেল কিছু পরই দুর্গে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে। আজিমপুরের ওই বাসিন্দা নিজের নাম-পরিচয় জানাতে রাজি হননি। তিনি বললেন, ‘কেউ মাস্ক পরে না, আমরাও তাই পরি নাই। গেটে মাস্ক পরে ঢুকতে বলছে, ঢুকছি। তারপর সবার মতো খুলে ফেলছি।’

মাসুদ নামের এক কলেজছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন লালবাগ দুর্গ জাদুঘরে। তাঁর মুখেও প্রায় একই কথা। বললেন, ‘মাস্ক পরে কি আড্ডা দেওয়া যায়? ছবি তোলা যায়?’

এ ব্যাপারে লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হালিমা আফরোজ প্রথম আলোকে গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমিসহ ৫০ জন লোক আছি। কিন্তু দর্শনার্থী আসছেন অনেক। এই দর্শনার্থীরা যদি নিজেরা সচেতন না হন, ভেতরে ঢুকে মাস্ক খুলে ফেলেন, তাহলে আর কিছু করার থাকে না। আমরা বারবার বলছি, ভেতরে আমাদের দুজন টহল দেন। কিন্তু দর্শনার্থীরা সচেতন থাকছেন না, মাস্ক খুলে ফেলছেন। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’

হালিমা আফরোজ বলেন, ‘আজকে (শুক্রবার) কিন্তু আমার ১০ হাজার দর্শনার্থী আছেন। তবে আজকের জন্য আমার জনবল বাড়ানো হয়নি। আজও ওই দুজনকেই টহল দিতে হচ্ছে, সচেতন করতে হচ্ছে। এটা কঠিন কাজ। আমি স্বীকার করছি, দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকে সচেতন থাকছেন না। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দিই না বলে অনেকেই বাইরে থেকে মাস্ক কিনছেন। তারপর ঢুকেই মাস্ক খুলে ফেলছেন। মাস্ক পরতে বললে কেউ কেউ বাজে আচরণও করেন কর্মীদের সঙ্গে।’