ফ্ল্যাটে উঠতে আর কত অপেক্ষা

২০১৭ সালে অনুমোদিত ফ্ল্যাট প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। ১৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের কাজ চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর গাবতলী সিটি পল্লিতে
সাবিনা ইয়াসমিন

২৫ বছরের বেশি সময় ধরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন হাসু বেগম। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে থাকেন গাবতলী সিটি পল্লির একটি ঝুপড়িতে। ১২ ফুট বাই ১৭ ফুটের ঘরটিতে ঠাসাঠাসি অবস্থা। সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ফ্ল্যাট দেবে—এমন খবর জানার পর থেকে আশায় দিন গুনছেন হাসু বেগম। কিন্তু তাঁর অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। কারণ, ২০১৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।

হাসু বেগম বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৭ নম্বর (রূপনগর) ওয়ার্ডে কাজ করেন। গত ৩০ মে তাঁর সঙ্গে কথা হয় গাবতলী সিটি পল্লির ঝুপড়িতে। তিনি বলেন, ‘সরকার একটা ফ্ল্যাটের আশা দেখাইসে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করছি। আদৌ বুঝে পাব কি না, জানি না।

ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন কাজ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয় ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে। প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৭৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কিন্তু কাজ শুরুর আগেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু বর্ধিত মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই দফায় আরও ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৫৪ কোটিতে।

এভাবে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা ও মূল্যবৃদ্ধি জনগণের টাকার অপচয়ের চূড়ান্ত উদাহরণ। এ বিষয়ে কারও না কারও নিশ্চয়ই গাফিলতি রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তির আওতায় না আনায় এমন ঘটনা বারবার ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

প্রকল্প শুরুর পর অনেক বছর হয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। মেয়াদের পর মেয়াদ বাড়ছে। কবে এই ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হবে, কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ইসমাইল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, স্ক্যাভাঞ্জার্স ইউনিয়ন

এই প্রকল্পের আওতায় গাবতলী সিটি পল্লিতে চারটি বহুতল আবাসিক ভবনে ৭৮৪টি ফ্ল্যাট তৈরি হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে ৫৬৬ বর্গফুট। এতে থাকবে দুটি শোবার কক্ষ, একটি রান্নাঘর, একটি শৌচাগার ও একটি বারান্দা। প্রকল্পের আওতায় একটি চারতলা স্কুল ভবন নির্মাণ করা হবে।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রথম দফায় অনুমোদিত সময়ে প্রকল্পের কাজই শুরু করা যায়নি। প্রকল্প এলাকাটি একসময় ডোবা ছিল। ভবন তৈরির জন্য পাইলিংয়ের যে গভীরতা নির্ধারণ করা হয়েছিল, বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে শক্ত মাটি পেতে তার চেয়ে গভীরে যেতে হয়েছে। এতে প্রকল্পের নকশায় বদল আনতে হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। ২০২০ সালে করোনার কারণে বেশ কয়েক মাস প্রকল্পের কাজ থমকে ছিল। গত কয়েক মাসে প্রকল্পের কাজ কিছুটা এগিয়েছে। তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্প পরিচালক ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নকশাসংক্রান্ত জটিলতার সমাধান করা হয়েছে। প্রায় ৭ বছর আগে তৈরি করা প্রথম দফার প্রকল্প প্রস্তাবে ব্যয় ছিল ১৭৭ কোটি টাকা। এত বছর আগের মূল্যে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তাই প্রকল্প ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে।

কাজ হয়েছে ২০ ভাগের কম

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মোট পাঁচটি প্যাকেজ বা ভাগে প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ২০ শতাংশের কম।

ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সংগঠন স্ক্যাভাঞ্জার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শুরুর পর অনেক বছর হয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। মেয়াদের পর মেয়াদ বাড়ছে। কবে এই ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হবে, কোনো নিশ্চয়তা নেই।

গাবতলী থেকে বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে কিছুটা এগোলে গাবতলী সিটি পল্লি। গত ৩০ মে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ভবনের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের প্রস্তুতি চলছে। আর তিনটি ভবনের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। স্কুল ভবনের পাইলিংয়ের কাজ শেষ।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাইশা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড সীমানাদেয়াল ও মাটি ভরাট, একটি ১৫ তলা ভবন এবং স্কুল ভবন নির্মাণের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক মো. আক্কাস প্রথম আলোকে বলেন, সব ভবনের পাইলিং হওয়ার পর মাটি ভরাট ও সীমানাদেয়ালের কাজ শেষ করা হবে।

বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয়

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিটি করপোরেশন তিন বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছরে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে না। ভবনের কাঠামো দাঁড়ালেও আনুষঙ্গিক অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম গত ২ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন থমকে ছিল। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিই। করোনার কারণে কাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। এখন একটা শেপে চলে এসেছে। এখন যে গতিতে কাজ আগাচ্ছে, তাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।’