বদলে যাওয়া ঢাকা যেমন আছে

কাঠের পাটাতন দিয়ে গুলিস্তানে ব্যারিকেড
ছবি: আসাদুজ্জামান

কাঠের তৈরি ছোট ছোট পাটাতনে জামাকাপড়ের পসরা সাজিয়ে গুলিস্তান মোড়ের ফুটপাতে দিনভর বিক্রি করতেন হকাররা। সেসব ছোট ছোট পাটাতন দিয়ে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার রোডটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নগরীর গুলিস্তান মোড় এখন জনশূন্য। মাঝেমধ্যে হুইসেল বাজিয়ে চলে পুলিশের গাড়ি। কখনো কখনো ছুটে চলে দু-একটা অ্যাম্বুলেন্স।

করোনার প্রকোপ ঠেকাতে দেওয়া কঠোর লকডাউনে কেবল নগরীর গুলিস্তান মোড় জনশূন্য তা নয়, পুরো ঢাকা এখন ফাঁকা এক নগরী। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় ব্যারিকেড দেওয়া, সেখানে অবস্থান নিয়েছেন পুলিশের সদস্যরা। বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরের যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, রায়সাহেব বাজার, মতিঝিল, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও মহাখালীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেল, জরুরি প্রয়োজনে যাঁরা সড়কে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হয়েছে।

ঢাকা নগরের সড়ক জনশূন্য
ছবি: আসাদুজ্জামান

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরে করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তখনো জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। করোনার আতঙ্কে তখনো ঢাকার সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। তবে সেবার নগরীর মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড ছিল না। সড়কগুলোয় রিকশা চলাচল ছিল বেশ। অবশ্য করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ভয়-আতঙ্কে মানুষ সেবার ঘর থেকে বের হয়েছিলেন একেবারে কম।

করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আজ বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। চলবে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত। বন্ধ আছে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস। বন্ধ আছে যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমান, ব্যক্তিগত গাড়ি ও দোকানপাট।

যাঁরা বাইরে বের হচ্ছেন, তাঁরা পুলিশি জেরার মুখোমুখি হচ্ছেন
ছবি: আসাদুজ্জামান

অচেনা এক ঢাকা

বছরে দুই ঈদে সাধারণত ঢাকার সড়কগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। তবে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে করোনায় সরকারি কঠোর বিধিনিষেধে নগরের অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যান। তখনো ঢাকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। এ বছরও করোনার প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা আসার পর নগরীর হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বিশাল অংশ ঢাকা ছেড়ে যায়।

পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দিন আজ। একই সঙ্গে আজ পয়লা বৈশাখ। এই দিনে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূল মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। সেই রমনা পার্ক, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ আজ জনশূন্য। রমনা পার্কের সব প্রবেশপথ বন্ধ। পয়লা বৈশাখে ঢাকা নগরীর মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আনন্দে মেতে উঠতেন। বাসায় বাসায় পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজার আয়োজন থাকত। কিন্তু করোনা কেড়ে নিয়েছে বাঙালির প্রাণের বৈশাখের চিরচেনা রূপ।

পয়লা বৈশাখে যে রমনা পার্ক মানুষের পদচারণে মুখর থাকত, তা আজ জনশূন্য
ছবি: আসাদুজ্জামান

পয়লা বৈশাখের কিছুদিন আগে থেকে সাধারণত ইলিশ মাছের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। কিন্তু এবারের চিত্র অন্য রকম। যাত্রাবাড়ীর মাছের বাজারে ইলিশ কেনার চাহিদা অন্যবারের মতো নেই। বড় ইলিশের দাম মাত্র ১ হাজার টাকা।

মাছ ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু বদলায় দিছে করোনায়। পয়লা বৈশাখের আগে ইলিশ কেনার ধুম পড়ত। কিন্তু এবার ইলিশের চাহিদা সেভাবে নাই। যাঁদের আয় ভালো, হাতে পয়সা, তারাই শুধু ইলিশ কিনতেছেন।’

ঈদের আগে নগরীর ব্যবসায়ীরা দোকানে দোকানে নতুন জামাকাপড় তুলে থাকেন। অন্যান্য বছর ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ, সদরঘাট, ইসলামপুর, চকবাজারে দেশের নানা প্রান্তের ব্যবসায়ীদের ভিড় জমে ওঠে। বুড়িগঙ্গার সদরঘাটের এপারে ইসলামপুর, ওপারে কালীগঞ্জ। কালীগঞ্জে ছোট ছোট জিনস প্যান্ট তৈরির কারখানা। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদরঘাটে দেখা গেল জনশূন্য কালীগঞ্জ মার্কেট। ইসলামপুরের সড়কে পুলিশের সরব উপস্থিতি, রাস্তা সব ফাঁকা।

করোনায় কঠোর লকডাউনে বদলে যাওয়া নগরীর বেশির ভাগ মানুষের অবস্থান এখন বাসায়। বাইরে বের হতে হলে লাগছে ‘মুভমেন্ট পাস’, আর তা সঙ্গে না থাকলে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। এ দিন নগরীর যাত্রাবাড়ীসহ নানা স্থানে টিসিবির খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, তেল, চিনি কিনতে ভিড় করতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকে।

নগরীর যাত্রাবাড়ীসহ নানা স্থানে টিসিবির খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, তেল, চিনি কিনতে ভিড় করতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকে
ছবি: আসাদুজ্জামান

রাস্তায় দেখা গেছে বেশ কিছু রিকশাও। মৎস্য ভবনের কাছে দেখা মেলে পুলিশের ৮ থেকে ১০ জন সদস্যের। সেখানে রাস্তায় দুটি রিকশা উল্টিয়ে রাখা হয়েছে। দুজন রিকশাওয়ালা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

দিনাজপুরের আবুল কাশেম রিকশা চালিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চালান। পুলিশের ভয়ে আজ তিনি আর রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হননি। তবে রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে আসেন সায়েদাবাদ মোড়ে। আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আমাদের গ্যারেজে এসে নিষেধ করে গেছে, কেউ যেন রিকশা নিয়ে রাস্তায় না বের হয়। আমাদের আর কী করার আছে?’