বসন্তের রঙে রঙিন হলো রাজধানী। নববসন্তে সোমবার মহানগরীর পথে পথে দেখা গেছে বাসন্তী রঙের পোশাক আর ফুলেল সজ্জায় সজ্জিত নানা বয়সী নগরবাসীর চলাচল। নাচে, গানে, প্রীতিবন্ধনে বসন্ত উৎসবেরও আয়োজন ছিল ফাল্গুনের পয়লা দিনটিতে। করোনা অতিমারির দুঃসময় কাটিয়ে জীবন ও প্রকৃতি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে উঠবে, এই প্রত্যাশায় বসন্ত বরণ করেছে নগরবাসী।
পয়লা ফাল্গুনের সঙ্গে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও ছিল সোমবার। আগে সাধারণত পয়লা ফাল্গুন ১৩ ফেব্রুয়ারি এবং ভালোবাসা দিবস পড়ত পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলা দিনপঞ্জিকা সংশোধন করে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জির সঙ্গে সমন্বয় করায় পয়লা ফাল্গুনও পড়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই। ফলে এক দিনে দুই আনন্দ উৎসবের উপলক্ষ থাকায় করোনার দুঃসময়ে অনেকটা দিন পর রাজধানীতে আনন্দের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল।
কর্মদিবস থাকায় অনেকেই তাঁদের কর্মস্থলেও গেছেন বাসন্তী সাজে। ওদিকে প্রণয়াকাঙ্ক্ষী তরুণ-তরুণীরা ঘুরতে বেরিয়েছেন জুটি বেঁধে। উপহার বিনিময় করেছেন পরস্পরে। ফুলের দোকানগুলোতে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা।
বসন্ত উৎসবের আয়োজন ছিল সকালে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়েছিল বসন্ত উৎসব। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ আহ্বান নিয়ে এবার ২৭তম বারের মতো এই উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় বসন্ত উদ্যাপন পরিষদ। বসন্তের ঐতিহ্যবাহী বাসন্তী রঙের শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবি পরে নানা বয়সী নরনারী উৎসবে অংশ নেন।
উৎসব শুরু হয়েছিল বেঙ্গল মিউজিকের শিক্ষার্থীদের এসরাজে ‘বাসন্তী রাগ’ পরিবেশনা দিয়ে। এরপর ছিল একক ও দলীয় আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা, বসন্তকথন, আবির বিনিময় আর প্রীতিবন্ধনী।
বসন্ত উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী জানান, প্রতিবার উত্তরা, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চ ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কেও একই সঙ্গে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে এবার করোনা অতিমারি পরিস্থিতির কারণে এসব কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও অনুষ্ঠান হয়েছে শুধু সকালে। বিকেলের অধিবেশন এবার আয়োজন করা হয়নি।
যন্ত্রবাদনের পর শিল্পী শামা রহমান গেয়ে শোনান ‘আমার মল্লিকা বনে’। মহাদেব ঘোষ পরিবেশন করেন ‘এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/ দেখা পেলেম ফাল্গুনে’। ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যাক্ষের শিল্পীরা। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সমবেত গান ছিল ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’। সুরবিহারের দলীয় গান ছিল ‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি’। বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি পরিবেশন করেন ‘ফুল ফাগুনের এলো মৌসুম’, বিমান বিশ্বাস শোনান ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’, নবনীতা জাইফ গেয়েছেন, ‘নব কিশলয়ে রাঙা’। আবৃত্তি করেছেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, নায়লা তারাননুম কাকলি—এভাবেই গানে, নৃত্যে, আবৃত্তিতে এগিয়েছে অনুষ্ঠান।
বসন্তকথনে সংগঠনের সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অতিমারির নিরানন্দ সময়ে বসন্তের প্রথম দিনে এই উৎসব জীবনে আনন্দ বয়ে এনেছে। ঋতুভিত্তিক উৎসগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি মানবিক বোধেরও বিকাশ ঘটাতে চাই। নগরজীবনে সেই লক্ষ্য নিয়েই ২৭ বছর ধরে এই উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে।’
বসন্তকথনের পর উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে আবির বিনিময় এবং প্রীতিবন্ধনী পরানো হয়। দলীয় পরিবেশনায় আরও অংশ নিয়েছে গানে সুরসপ্তক, নৃত্যে ধ্রুপদ কলাকেন্দ্র, সাধনা, নৃত্যম, মুদ্রা ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্স, পুষ্পাঞ্জলি, স্পন্দনসহ বিভিন্ন সংগঠন। বেলা প্রায় ১১টা পর্যন্ত চলেছে বসন্তবরণের এই সাংস্কৃতিক উৎসব।