বস্তিতে ঝকঝকে টয়লেট

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া পিংকি আক্তার টয়লেট ব্যবহার করা নিয়ে একসময় বেশ ভোগান্তিতেই পড়ত। মাসিক হলে তো কথাই নেই। বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশে সবার সঙ্গে নোংরা টয়লেট ব্যবহার করতেই বাধ্য ছিল সে। কিন্তু বছরখানেক কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে একটি কমিউনিটি ওয়াশ সেন্টার তৈরি হয়েছে। পিংকি এখন নিশ্চিন্ত মনে সেটি ব্যবহার করে।

গত বছরের অক্টোবরে কল্যাণপুর পোড়া বস্তির ৪ নম্বর ব্লকে ইউনিলিভার বাংলাদেশের সহায়তায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভূমিজ একটি কমিউনিটি ওয়াশ সেন্টার করেছে। তাদের সঙ্গে আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও নগর বস্তিবাসী উন্নয়ন সংঘ। স্থানীয়ভাবে এটি দোতলা টয়লেট নামেও পরিচিত। সম্প্রতি বস্তির এই ওয়াশ সেন্টারটি ঘুরে দেখা যায়, রেনু বেগম নামের একজন পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত। টয়লেটটি বেশ ঝকঝকে। ব্যবহারকারীরাও সচেতনতা মেনে চলছেন।

বস্তিবাসী জাকিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইটা বানানোর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হইছে কিশোরীদের। আগে মহিলা–পুরুষের আলাদা টয়লেট ছিল না। কারেন্ট থাকত না। বদনা হাতে করে নিয়া যাইতে হইত। মেয়েগুলো লজ্জাও পাইত।’

ওয়াশ সেন্টারটির দোতলায় ছেলেদের চারটি টয়লেট ও একটি গোসলখানা। নিচ তলায় মেয়েদের তিনটি টয়লেট ও একটি গোসলখানা। এ ছাড়া হাত ধোয়ার আলাদা ব্যবস্থাও আছে। এ সেন্টারটির তত্ত্বাবধায়ক ইব্রাহিম রানা প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির ৪৬টি পরিবার এখান থেকে স্যানিটেশন সুবিধা নেয়। মাসে পরিবারপ্রতি ফি ৬০ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ২৫০ জনের মতো মানুষ এই টয়লেট ব্যবহার করে।

এ ছাড়া খাওয়ার পানির সুবিধা আছে। প্রতি লিটার এক টাকা। একটি ওয়াশিং মেশিনও আছে। তাতে ১ কেজি কাপড় ধুতে ৫০ টাকা খরচ।

ওয়াশ সেন্টারে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন রেনু বেগম। সেন্টারের পাশেই তাঁর বাসা। তিনি জানান, সারাক্ষণই তিনি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেন। টয়লেট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে ইউনিলিভারের ডোমেক্স ব্যবহার করেন। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই ওয়াশ সেন্টার পুরোটা খোলা থাকে। তবে রাত ১০টার পর শুধু নিচতলা খোলা রাখা হয়।

ওয়াশ সেন্টার ব্যবহারকারী খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরে ঘরে আগে ডায়রিয়া ছিল। টয়লেট ব্যবহার করার পর পোলাপান হাত ধুইতে চাইত না, পরিবেশও নোংরা থাকত। কিন্তু এখন সাবান আছে, পানি আছে, সব পরিষ্কার। অসুখ–বিসুখও কমছে।’

বস্তিবাসীর জীবনমানে পরিবর্তন আনতে কমিউনিটি ওয়াশ সেন্টার ভূমিকা রাখছে বলে জানান বস্তির কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশনের (সিবিও) সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান আকন্দ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির অন্যান্য ব্লকেও এমন ওয়াশ সেন্টার প্রয়োজন।

টয়লেট বানানোয় সুবিধা হইছে কিশোরীদের। আগে মহিলা-পুরুষের আলাদা টয়লেট ছিল না। বদনা হাতে নিয়া যাইতে হইত। মেয়েগুলো লজ্জাও পাইত।
জাকিয়া আক্তার, কল্যাণপুর বস্তির বাসিন্দা

ওয়াশ সেন্টারটি বাস্তবায়ন করেছে সামাজিক উদ্যোগ (সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ) প্রতিষ্ঠান ভূমিজ, যারা স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করে। এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফারহানা রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাবলিক টয়লেট নিয়ে নিজেরা সব সময় ভুগেছি। নারী হিসেবে তা আরও বেশি ছিল। এখানে কাজ করার সুযোগ আছে। ছোট একটা কাজ, কিন্তু অনেক মানুষ উপকার পাচ্ছে। এ ছাড়া এখন করোনার জন্য স্যানিটেশন অনেক জরুরি।’

কল্যাণপুরের ওয়াশ সেন্টার নিয়ে ফারহানা রশীদ বলেন, বস্তিগুলোতে বেশির ভাগ সময় নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ থাকে না। হাত ধোয়ার জায়গাও থাকে না। সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের কেউ না থাকায় বানানোর কয়েক দিন পর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এই টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতার জন্য বস্তি থেকেই লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় সাতটি এলাকার পাবলিক টয়লেট নিয়ে কাজ করছে ভূমিজ। এগুলো হলো কল্যাণপুর পোড়া বস্তি, গাউছিয়া–নূর ম্যানশন, গুলশান –২, নাবিস্কো, সাত রাস্তা, ট্র্যাকস্ট্যান্ড, এয়ারপোর্টে রেলওয়ে স্টেশন।

কল্যাণপুর পোড়া বস্তি ছাড়াও ইউনিলিভারের সহায়তায় ভূমিজ ঢাকা উত্তর সিটির পাঁচটি বাজারে স্যানিটেশনের কাজ করছে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, গুলশান–১ কাঁচাবাজার, কারওয়ান বাজার ও মিরপুর। আরেকটি টয়লেটের জায়গা এখনো নির্ধারিত হয়নি।

ফারহানা রশীদ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর পাবলিক স্যানিটেশন ব্যবহারে মানুষ কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে এবং মানুষের জন্য তা কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকেন। ভূমিজ, ইউনিলিভারের সহযোগিতায় তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্পর্শবিহীন স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করেছেন।