বাঘ, সিংহসহ ৮ প্রাণীর মৃত্যু আড়াই মাসে

ছয়টি প্রাণীর মৃত্যু প্রকাশ্যে আসেনি। নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে মুক্ত রাখতে নিয়মিত টিকা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দূর থেকে জিরাফের গায়ে ট্রাঙ্কুলাইজিং গানের মাধ্যমে টিকা দিচ্ছেন ভেটেরিনারি সার্জন নাজমুল হুদা। সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায়
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় বিগত প্রায় আড়াই মাসে আটটি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু দুটি প্রাণীর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এসেছে।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত ৩০ অক্টোবর প্রায় আট মাস বয়সী একটি জেব্রা মারা যায়। ২০ ও ২১ নভেম্বর মারা যায় দুর্জয় ও অবন্তিকা নামের পাঁচ মাস বয়সী দুটি ব্যাঘ্রশাবক। ২৭ নভেম্বর মৃত্যু হয় ২ মাস ১৮ দিন বয়সী একটি জিরাফশাবকের। ১০ ডিসেম্বর মারা যায় ছয় মাস বয়সী একটি ইম্ফালা।

জানুয়ারি মাসে জাতীয় চিড়িয়াখানায় মৃত্যু হয়েছে দুটি প্রাণীর—১৫ জানুয়ারি মারা যায় ৪ মাস বয়সী একটি জিরাফশাবক এবং ২৫ জানুয়ারি মৃত্যু হয় ১২ বছর বয়সী একটি আফ্রিকান সিংহের। সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি ১৮ বছর বয়সী একটি ওয়াইল্ড বিস্ট মারা যায়।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর মধ্যে শুধু দুটি ব্যাঘ্রশাবক মারা যাওয়ার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। আর রংপুর চিড়িয়াখানায় ৫ ফেব্রুয়ারি যে বাঘিনী মারা গেছে, সেটার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

চিড়িয়াখানায় অল্প সময়ে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যু একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাদাভাবে এবং বিস্তারিত তথ্য দিয়ে জানানো উচিত ছিল, তারা তা করেনি।
শ ম রেজাউল করিম মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী

চিড়িয়াখানায় প্রাণীর মৃত্যুর বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহীর মৃত্যুর পর। এই সব প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাত পাওয়া, বিষক্রিয়া, অ্যানথ্রাক্স ও নিউমোনিয়াকে দায়ী করা হয়।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণীগুলোর মৃত্যুর বিষয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চিঠি-চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের সঠিক উপায়ে বিষয়টি জানানো হয়নি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানায় অল্প সময়ে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যু একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাদাভাবে এবং বিস্তারিত তথ্য দিয়ে জানানো উচিত ছিল, তারা তা করেনি।

প্রতি শীতে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো নানা কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবারের শীতে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা বেশি। আমরা আরও কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আবদুল লতিফ

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়কে অন্যান্য তথ্যের ফাইলের সঙ্গে এই তথ্যগুলো জানিয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে যেসব প্রাণী মারা গেছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করতে আবারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা জাতীয় চিড়িয়াখানা। এতে মোট প্রাণী রয়েছে ৩ হাজার ১০০টির মতো।

জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর শীতে পাঁচ থেকে সাতটি প্রাণী মারা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারি আকৃতির প্রাণীর মৃত্যু বেশি হয়। গত বছর জাতীয় চিড়িয়াখানায় সাতটি প্রাণী মারা যায়। এর মধ্যে ছিল জিরাফ ও জেব্রা। তবে বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি আকৃতির প্রাণী। এবার বাঘ, সিংহ, জেব্রা ও জিরাফের মৃত্যু ঘটল।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি শীতে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো নানা কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবারের শীতে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা বেশি। আমরা আরও কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি।’

যেসব কারণে মৃত্যু

জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের নিজেদের তদন্তে বলা হয়েছে, গত আড়াই মাসে মারা যাওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে তিনটির মৃত্যু হয়েছে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে—জেব্রা, জিরাফশাবক এবং ওয়াইল্ড বিস্ট। আফ্রিকার সিংহের মৃত্যু হয় অ্যানথ্রাক্সে, যেটিও একধরনের ব্যাকটেরিয়া। ব্যাঘ্রশাবক দুর্জয় ও অবন্তিকার মৃত্যু হয়েছে বিশেষ মাছির মাধ্যমে ট্রাইপানোসোমিয়াসিস নামের এক রোগে আক্রান্ত হয়ে। ইম্ফালার মৃত্যুর কারণ হাইপক্সিয়াফলিড রোগ। আরেকটি জিরাফশাবকের শরীরে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গত সোমবার জাতীয় চিড়িয়াখানা পরিদর্শনে যান। সূত্র বলছে, তখন মন্ত্রীকে জানানো হয়, এই প্রাণীগুলোর মৃত্যু নিয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছে। এতে জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এলেও আক্রান্ত কীভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু পাওয়া যায়নি।

মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে তদন্তের জন্য গঠন করা কমিটির সদস্য করা হয়েছে জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহিদুল্লাহকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। এরপর এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাবে।

‘যুক্তি গ্রহণযোগ্য না’

মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রাণীগুলোকে কী ধরনের খাবার দেওয়া হয়েছে, কখন দেওয়া হয়েছে, তারা কত দিন ধরে অসুস্থ ছিল, তাদের জন্য কী ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং প্রাণীগুলোর খাঁচায় পাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পালনসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।

বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানায় মারা যাওয়া বন্য প্রাণীগুলোর বেশির ভাগই আফ্রিকা থেকে আনা। সেখানে ওই প্রাণীগুলো সব ধরনের ঋতুতে টিকে থাকতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশে আনার পর শীত এলেই তাদের অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, শীতে মৃত্যু বেড়ে গেলে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ কেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয় না।