বাথরুমে গিয়ে আর ফিরল না ওরা, দিশেহারা মা–বাবা

২১ অক্টোবর বিকেল ৫টার দিকে বাসার বাথরুমে গিয়ে মারা যায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা মাসুদ পথিকের একমাত্র ছেলে অঋব অনুসূর্য
ছবি: সংগৃহীত

অঋব মানে সুপ্রত্যাশিত আর অনুসূর্য মানে আলোকরশ্মি। এ দুটো মিলেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ পথিক ছেলের নাম রেখেছিলেন অঋব অনুসূর্য। ছেলের প্রতিভা দেখে তিনি ছেলেকে ডাকতেন ‘বিস্ময় বালক’। এই বিস্ময় বালকের বয়স ছিল ১০ বছরের কাছাকাছি। সে পড়ত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে। ২১ অক্টোবর বিকেল ৫টার দিকে বাসার বাথরুমে (শৌচাগার) গিয়েছিল। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও ছেলে বের হচ্ছে না দেখে ডাকাডাকি শুরু করেন তার বাবা ও মা তামান্না সেতু। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বাথরুমের দরজা ভেঙে দেখা যায় অনুসূর্য হাই কমোডের পাশে পড়ে রয়েছে।

মাথায় আঘাত পেয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সে মারা যায়। তারপরও তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসকও একই কথা জানান। মাসুদ পথিক নিজেই তাঁর ফেসবুক পেজে ছেলের মৃত্যুর খবরটি জানান।

৫ অক্টোবর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ফেসবুক গ্রুপে জানানো হয়, মূল প্রভাতি শাখার পঞ্চম শ্রেণির ‘ক’ শাখার শিক্ষার্থী আমায়রা আরিবা সাঝফা ৪ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে বাথরুমে পড়ে মারা গেছে।
এক মাসের মধ্যে রাজধানীতেই বাথরুমে পড়ে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা অন্যান্য অভিভাবকের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি করেছে। ফেসবুকেও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

আজ মঙ্গলবার কথা হয় মাসুদ পথিক এবং আমায়রা আরিবার বাবা প্রকৌশলী আবদুল করিমের সঙ্গে। দুই বাবাই বললেন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের আর ফিরে পাবেন না। তবে অন্য অভিভাবকদের সচেতনতায় হয়তো এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি আর না–ও ঘটতে পারে। সন্তান বাথরুমে গেলে অন্তত অভিভাবকেরা যাতে একটু সজাগ থাকেন, সে আহ্বান জানান তাঁরা।

অঋব অনুসূর্য ছিল মাসুদ পথিক ও তামান্না সেতু দম্পতির একমাত্র সন্তান। তাঁদের বাসা রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে। মাসুদ পথিক জানালেন, নরসিংদীর রায়পুরায় তাঁর বাবার কবরের পাশেই ছেলের কবর দেওয়া হয়েছে। জানালেন, যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, তার আধা ঘণ্টা আগেই ছেলে ছয়তলা বাসার নিচে নেমে ওষুধ কিনে এনে দেয়। তিনি সেই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আর ছেলের আরও কম বয়স থেকে বই পড়ার নেশা। খাওয়ার টেবিল এবং বাথরুমে গেলেও তার হাতে বই থাকত। তাই বাথরুমে গেলেও তার সময় লাগত। ঘটনার দিনও বিষয়টি তেমনই বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। তবে ২০ থেকে ২৫ মিনিটেও ছেলে বের হচ্ছে না, একসময় তামান্না সেতু বিষয়টি নজরে এনে ছেলেকে ডাকাডাকি করেন। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে মাসুদ পথিককে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তারপর দরজা ভাঙা হয়।

মাসুদ পথিক বললেন, বাথরুম পিচ্ছিল থাকার কথা নয়। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। তবে কোনোভাবে ছেলে হয়তো পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রান্নাঘর বা আমার ঘর থেকে সে শব্দ আমরা শুনতে পাইনি। শব্দ শুনতে পেলে বা ছেলে বাথরুমে আছে, একটু খেয়াল করতে হবে, সে চিন্তা মাথায় থাকলে হয়তো ছেলেকে জীবিত পেতাম।’

মাসুদ পথিক বলেন, ‘ছেলে এই বয়সেই ২০০–এর বেশি বই পড়ে ফেলেছিল। আমার চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট দেখে ছেলে বকা দিত কেন এত বানান ভুল হয়। গানের সুরও করেছিল ছেলে। ছেলে চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের চোখে ঘুম নেই। মাথায় ছেলের চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই।’

মাসুদ পথিক জানান, ছয় থেকে সাত মাস আগে ছেলের মুসলমানি করানো হয়। এর পর থেকে বাথরুমে গেলে ছেলে দরজা লাগিয়ে দিত। ছেলে একটু চঞ্চল ছিল। তবে তা মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। স্বাভাবিক প্রসবে ছেলের জন্মের পর এই বয়স পর্যন্ত সাধারণ জ্বর-সর্দি ছাড়া ছেলের কখনোই তেমন কোনো বড় অসুখ হয়নি।

প্রকৌশলী আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বাচ্চারা গোসল করতে গেলে বা বাথরুমে গেলে দরজার ছিটকিনি যাতে না লাগায়, তা একটু নজরে রাখতে হবে। ছিটকিনি লাগালেও বাথরুমে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে খেলছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে।

রামপুরার বাসিন্দা আবদুল করিম বললেন, ‘মেয়ে দ্রুত সব কাজ শেষ করত। হাতে কোনো কাজ না থাকলে অস্থির হয়ে যেত। বাথরুমে ঢুকে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে অনেকক্ষণ খেলত। ঘটনার দিন রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করতে গিয়েছিল। ঘটনার দিন আমি বাসার বাইরে ছিলাম। মেয়ের মা শাহীনুর আক্তার কাজ করছিলেন। তারপর মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে আমাকে ফোন দেন। আমি গিয়ে মেয়েকে বাথরুমে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করি। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক বলেন, মেয়ে আর নেই।’

আবদুল করিম ও শাহীনুর আক্তার দম্পতির আরেক মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনের জন্য মেয়ের একটি ছবি চাইলে আবদুল করিম বলেন, ‘থাক, মেয়েটা তো আর নেই, তাই আমরা ওর ছবি ছাপতে চাচ্ছি না। তবে চাই অন্য অভিভাবকেরা সচেতন হোক।’

অঋব অনুসূর্য
ছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক চিকিৎসক এ কে এম ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিশুরা পানি দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। আর পানিতে পড়ে মৃত্যুর জন্য খুব বেশি পানির প্রয়োজন নেই। বাথরুমের বালতির পানিতে পড়েও ছোট শিশুরা মারা যায়। এ নিয়ে বলতে বলতে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। বাথরুম পিচ্ছিল থাকা বা অন্যান্য অব্যবস্থাপনার কারণেও শিশুরা মারা যেতে পারে, তা নিয়েও কথা বলা শুরু করতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। বাথরুম পিচ্ছিল থাকলে তা শুধু শিশু নয়, বয়স্কদের ক্ষেত্রেও তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বা যেকোনো বয়সীরাই দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। তাই বাথরুম যাতে পিচ্ছিল না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো বাথরুম ব্যবস্থাপনার কথা বললে তা চট করে সবাই করতে পারবে না। তাই সন্তান বা শিশুরা বাথরুমে গেলে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-এ দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এরপরই পানিতে ডুবে মৃত্যুর স্থান। এটি প্রায় ৯ শতাংশ।

ডুবে মৃত্যু নিয়ে সর্বশেষ ২০১৬ সালে করা বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের প্রতিবেদন আছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর (আঘাতজনিত) ৩৭ শতাংশই হয় পানিতে ডুবে। সেই হিসাবে, বছরে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু ডুবে মারা যায়। তবে বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে কত শিশু মারা যায় দেশে, সে ধরনের কোনো জরিপ নেই।

১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’। শিশুতোষ চলচ্চিত্রটির কাহিনি ছিল, ঈদের ছুটি ঘোষণার পর ১২ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী স্কুলের বাথরুমে আটকে পড়া ঘিরে। তারপর ১০ দিন সেখানে বন্দী অবস্থায় থাকার পর এ শিক্ষার্থী মারা যায়। তবে রাজধানীর অঋব অনুসূর্য ও আমায়রা আরিবা সাঝফা স্কুল বা বাইরে কোথাও নয়, নিজের বাসার বাথরুমে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এই দুই শিশুর অভিভাবকেরা বাসার বাথরুমকে নিরাপদই ভেবেছিলেন।