‘বাসওয়ালারা কি ঢাকার ছাত্রদের খুঁইজা খুঁইজা মারতেছে?’

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফলের অপেক্ষায় ছিল মাইনুদ্দিন ইসলামছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর রামপুরায় বাসচাপায় নিহত এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের পকেটে মৃত্যুর ২০ মিনিট আগে ছিল মাত্র ৪ টাকা। মায়ের কাছে আরও ৫ টাকা চাইলে তিনি ১০ টাকার একটা নোট হাতে দিয়েছিলেন। লাফিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল মাইনুদ্দিন। আধা ঘণ্টা পরই বাবা আবদুর রহমান যখন ঘরে এলেন, তখন তাঁর লুঙ্গি আর শার্টে ছোপ ছোপ রক্ত ছেলের শরীরের।

ছেলে হারিয়ে শোকে বিহ্বল রাশেদা বেগম
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

দুর্ঘটনার নিহত মাইনুদ্দিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে রাশেদা বেগম পথে বসে আছেন। সারা রাত এক জায়গা থেকে নড়েননি। পূর্ব রামপুরায় নিজের ভাড়া বাড়ির ঘরে তালা ঝুলিয়েছেন। ছেলে ফেরার আগে নাকি ঘর খুলবেন না। তবে ছেলে আর কখনো থাকবে না এ ঘরে। এই তো কয়েক ঘণ্টা আগেও খাটে শুয়ে শুয়ে বলেছে, ভালো কলেজে পড়লেই হবে না; প্রাইভেট লাগবে। খরচ কি চায়ের দোকান থেকে জোগাড় হবে?

গতকাল সোমবার রাতে রামপুরায় বাসচাপায় নিহত মাইনুদ্দিনদের পাঁচ সদস্যের পরিবারটি চলে মহল্লার এই ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে আসা আয়ে। রাশেদা বেগম আর আবদুর রহমান দম্পতি ১৫ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসেছেন। দুজন মিলে দোকানটি পালা করে চালিয়ে নিচ্ছেন। সে দোকানে কাল রাত থেকে তালা।

মাইনুদ্দিনদের ভাড়া বাড়ির যাতায়াতের সরু পথ
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

দোকানের সামনে দাঁড়াতেই বয়স্ক এক নারী হাত দিয়ে দেখালেন, এই বেঞ্চটায় কাল বিকেলেও বসেছিল ছেলেটা। গোসল-খাওয়ার জন্য দুপুরে বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে ঘণ্টা দুই নিজেই দোকান চালাত। অভাবী সংসারে থেকেও ছেলেটার পড়ালেখা আর খেলাধুলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। সবার সঙ্গে ডেকে ডেকে হেসে আলাপ করত বলে ওকে একনামে চেনে সব বয়সী মানুষ। এ দোকানের মুখোমুখি গলিতেই মাইনুদ্দিনদের সেই ভাড়া বাড়ি। অন্য একজন এগিয়ে এসে নিয়ে গেল ওর মায়ের কাছে।

গতকাল সোমবার বিকেলেও নিজেদের ছোট চায়ের দোকানে বসেছিল মাইনুদ্দিন
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

ছেলের মৃত্যুর পর থেকে রাশেদা বেগম বড় মেয়ে ঝুমার ঘরের সামনেই বসে আছেন। এর মধ্যে শেষ হয়েছে একটা রাত। আজ মঙ্গলবার সকালে রাশেদা বেগমের কাছে গেলে তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের দিয়া আমার কী হবে? আমার ছেলেরে আইনা দিতে পারবেন? বাসওয়ালারা কি ঢাকার ছাত্রদের খুঁইজা খুঁইজা মারতেছে?’ সারা রাত ধরে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সন্তান হারানো মা। এখন শুরু হয়েছে স্মৃতিকথা আর ক্ষোভ।

মাইনুদ্দিনের বাক্‌প্রতিবন্ধী বড় বোনের (মাঝখানে) হাহাকার অনুচ্চারিত
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

রাশেদা বেগমের এই ছোট ছেলে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে কিছুদিন আগে পর্যন্ত হালিম বিক্রি করেছে। মা বানিয়ে দিতেন সেই হালিম। বড় ভাইটি লেখাপড়া করেননি। তাই সে চাকরি করে সংসারের হাল ধরার আশ্বাস দিত অভাবী মা-বাবাকে। বড় ভাই ব্যবসা করতে অন্যের কাছ থেকে লাখ দুই টাকা ধার নিয়েছিলেন বলে দুশ্চিন্তায় ছিল মাত্র ১৭ বছরের মাইনুদ্দিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জমি বিক্রি করে হলেও সে টাকা শোধ করতে মাকে অনুরোধ করছিল কয়েক দিন ধরে। বয়সে অনেক ছোট হয়েও এই সংবেদনশীলতার জন্যই হয়তো ওর এমন মৃত্যুতে গোটা এলাকা থমথমে। সব মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাইনুদ্দিনের মা-বাবার পাশে।

বড় ভাই ব্যবসা করতে অন্যের কাছ থেকে লাখ দুই টাকা ধার নিয়েছিলেন বলে দুশ্চিন্তায় ছিল মাত্র ১৭ বছরের মাইনুদ্দিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জমি বিক্রি করে হলেও সে টাকা শোধ করতে মাকে অনুরোধ করছিল কয়েক দিন ধরে।

পথের পাশে বসে থাকা সদ্য সন্তান হারানো আবদুর রহমান এখনো মানছেন না ছেলে নেই। তিনি বারবার হাত বাড়িয়ে ডাকছেন ছেলেকে। গত রাত থেকে পানিও খাননি। কেউ বোঝাতে গেলেই বলছেন, ‘হাসপাতাল থেকে আমার “মাইনু” আগে ফিরে আসুক। ওর হাতে পানি খাব।’

সন্তান হারিয়ে বাবার হাহাকার
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

অথচ গত পরশু দুপুরেও তিনি মাইনুদ্দিনকে দোকানে রেখে ফিরে এসে দেখেছিলেন, ছেলে চা বানিয়ে তাতে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। এটা ওর প্রিয় খাবার। বাবা কপট রেগে বলেছিলেন, ‘তোর আলসার হবে এমন চা খেয়ে।’ ছেলে উত্তর দিয়েছে, ‘আমার শরীর অনেক ফিট। এক–আধটু চা খেলে কিছু হয় না।’

পরিবারের সবার চেয়ে বেশ কিছুটা লম্বা মাইনুদ্দিন। তাই গর্ব ছিল নিজের উচ্চতা নিয়ে। দিনে কয়েক দফায় চার বছরের বড় ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলত, ‘দেখলি, তোর চেয়ে আমি কত বড়?’ ওকে বড় হওয়ার কথা বলতেন ভাই। এসবই এখন স্মৃতি নিহত মাইনুদ্দিনের পরিবারের কাছে। সেই বড় ভাই গত রাত থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায়। ছোট ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। পথ থেকে এক চুল নড়েননি মা। আর ছেলের হাতে ছাড়া পানিও খাবেন না বাবা।

মাইনুদ্দিনের মৃত্যুতে এলাকাবাসীর ভেতরও নেমে এসেছে শোক
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

তবে এসব যন্ত্রণা তাও ভাষায় শোনা হলো, কিন্তু যাঁর মুখে ভাষা নেই, তাঁর আর্তনাদই বোধ হয় সবচেয়ে ভয়াবহ। মাইনুদ্দিনের সব আবদার ছিল আট বছরের বড় বোন ঝুমার কাছে। ঝুমা কথা বলতে পারেন না। কয়েকবার শুধু নিজের বুকে হাত রেখে দীর্ঘনিশ্বাস নিলেন। বাকহীন মানুষও উচ্চ স্বরে শব্দ তোলার চেষ্টা করলেন। যে শব্দ কান পেতে শুনলে বোঝা যায়, তিনি বলতে চাইছেন, আমার ভাই, আমার ভাই।

নিহত প্রাণচঞ্চল উচ্ছল মাইনুদ্দিন মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছিল, ‘ঠিক ততটা আঁধারে হারিয়ে যাব, যতটা অন্ধকারে হারালে কেউ সন্ধান পাবে না।’ রাশেদা বেগম ছেলের কান টেনে ধরে জানতে চেয়েছিলেন, এসবের অর্থ কী? প্রাণখোলা হাসি দিয়ে ও জানিয়েছিল, মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা।

বাসচাপায় প্রিয় সন্তানের মৃত্যুতে নির্বাক মা
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

মাইনুদ্দিন এখন শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরের টেবিলে। ময়নাতদন্তের পর ওর মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন বড় ভাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে মাইনুদ্দিনের মরদেহ। বড় ভাই কবরে নামাবেন ছোট ভাইকে। কিন্তু দুই ভাইয়ের আর কোনো দিন উচ্চতা নিয়ে বাদবাদি হবে না। শুয়ে থাকা মানুষের সঙ্গে দৈর্ঘ্যের মাপ দেওয়া যায় না।