বৃষ্টির পানি সরেই না, অন্যের ওপর দায় দিয়ে 'কর্তব্য' শেষ

দেশের ছোট-বড় সব শহরেই জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন অথবা পৌর কর্তৃপক্ষের। ব্যতিক্রম শুধু রাজধানী ঢাকা। এই শহরের পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব ছয়টি সংস্থার। এত সংস্থার একসঙ্গে কাজ করার ফল কী, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। ভারী বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় ঢাকা শহরের বড় একটি অংশ। সাধারণ মানুষকে হাঁটুপানি ঠেলে চলতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় স্থবির হয়ে থাকে যানবাহন। আর সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের ‘কর্তব্য’ শেষ করে।

রাজধানীর পানিনিষ্কাশনের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানও জলাবদ্ধতা নিরসনে ভূমিকা রাখে।

যদিও আইন ও কর্মপন্থা অনুযায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তুলনামূলকভাবে ছোট নালা, কয়েকটি খাল এবং কয়েক কিলোমিটার বক্স কালভার্ট দেখভাল করে দুই সিটি করপোরেশন। পুরো শহর নিয়ে পরিকল্পনার পাশাপাশি হাতিরঝিল, উত্তরা ও গুলশান-বনানী এলাকার খাল আছে রাজউকের আওতায়। ঢাকা শহরের চারপাশের স্লুইসগেটগুলোর দায়িত্বে পাউবো। সেনানিবাস এলাকার পানি নিষ্কাশন করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকার পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানের।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছয় সংস্থা ও আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেককেই লিখিতভাবে দায়িত্ব দেওয়া আছে। তারা সে অনুযায়ী কাজ করলেই সমস্যা হতো না। কিন্তু বাস্তবে তাদের কাজে সমন্বয় হচ্ছে না। এমন অবস্থায় একটি সংস্থার কাছে পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব হস্তান্তরই ভালো হবে। হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য না হয়। না হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা চলতেই থাকবে।

ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানির সিংহভাগ নিষ্কাশিত হয় ওয়াসার তত্ত্বাবধানে থাকা ২৬টি খাল ও বড় নালার মধ্য দিয়ে। খাল ও নালা খনন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব এই সংস্থার। কিন্তু ওয়াসা ঠিকমতো খাল ও নালা পরিষ্কার করে না, এ অভিযোগ সিটি করপোরেশনের। আর ওয়াসা বলছে, সিটি করপোরেশন যথাযথভাবে আবর্জনা সংগ্রহ না করায় নালা ও খালে আবর্জনা জমে থাকে। এতে পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

গত ১৯ ও ২৮ জুন ভারী বৃষ্টির কারণে রাজধানীর অনেক এলাকার সড়ক হাঁটুপানিতে ডুবে ছিল। করোনা সংক্রমণের এই সময়ে রাস্তায় মানুষ ও যান চলাচল কম থাকার পরও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি সইতে হয়েছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গত ১৮ মার্চ একটি সভা হয়েছিল। সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘খালগুলোর কোনো মা-বাপ নাই। ওয়াসাকে বললে বলে, এটা আমার না। সিটি করপোরেশনকে বললে বলে, এটা ওয়াসার। এমন খেলা চলতে পারে না।’

খেলা থেমে নেই

জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব কে পালন করবে, তা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয় গত ২৭ জুন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্যমান জনবল, যন্ত্রপাতিসহ ওয়াসার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার দাবি জানান। ওয়াসার জবাবদিহি না থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।

মেয়রের এ মন্তব্যের পর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বক্তব্য জানতে চায় প্রথম আলো। লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ড্রেনেজ পরিষেবার দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনকে অথবা একটি সংস্থার হাতে ন্যস্ত করার জন্য ওয়াসা ২০১১-১২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হলে অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করবেসা।

ওয়াসা সূত্র জানায়, জলাবদ্ধতা নিরসনকাজের জন্য জনবল ও যন্ত্রপাতি আছে তাদের। খাল ছাড়াও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট এবং ৩৮৫ কিলোমিটার নালা সংস্কারের দায়িত্বও ওয়াসার। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য ওয়াসার ড্রেনেজ (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) সার্কেল, ড্রেনেজ গবেষণা ও উন্নয়ন সার্কেল এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (ড্রেনেজ) বিভাগ রয়েছে। এই দুই সার্কেল ও বিভাগে ১৩৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।

ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, পুরোনো নালা ও খাল দেখভাল করে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল। এই সার্কেলে এখন আর ওয়াসা নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয় না। এ বছর এই সার্কেল পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে সব নালা ও খাল পরিষ্কার করতে পারেনি।

রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া নতুন নালা নির্মাণের কাজ করে ড্রেনেজ গবেষণা ও উন্নয়ন সার্কেল। আর ওয়াসার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (ড্রেনেজ) বিভাগের কাজ মূলত লেভেল সার্ভে (জরিপ), পাইপের আকার নির্ধারণ ও নালার নকশা করা। নতুন প্রকল্প না থাকলে এই সার্কেল ও বিভাগেরও তেমন করণীয় কিছু থাকে না।

ওয়াসা সূত্র জানায়, গত তিন অর্থবছরে (২০১৭–১৮ থেকে ২০১৯–২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত) খাল ও নালা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য অন্তত ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক কোনো বরাদ্দ রাখে না। বিভিন্ন সড়ক সংস্কার ও নির্মাণের সময় কাজটি করা হয়। তাই এই খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় গত তিন অর্থবছরে শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

অন্য শহর যেভাবে চলে

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাড়া সারা দেশের আরও ১০টি বড় শহরে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ আছে। এই ১০টি শহরেই জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব এককভাবে সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী শহরে ওয়াসার কার্যক্রম আছে। এই তিন শহরে ওয়াসার দায়িত্ব পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে সীমাবদ্ধ। তবে ১০টি শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব এককভাবে সিটি করপোরেশনের কাছে থাকলেও এসব শহরেও জলাবদ্ধতা হয়।

মন্ত্রণালয়ের ভাবনা

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব কার কাছে যাবে, এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হুট করে তো সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া যায় না, এ জন্য সক্ষমতা দরকার। সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, সময়ের ব্যবধানে হয়তো অনেক দায়িত্বই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হতে পারে। তিনি বলেন, যেভাবেই হোক ঢাকা ওয়াসা কাজ চালাচ্ছে, যোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে এই দায়িত্ব হস্তান্তর করা হলে ভোগান্তি বাড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞের মত

নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব অবশ্যই একক সংস্থার হাতে থাকা উচিত। এতে অন্তত ওই সংস্থা দায় এড়াতে পারবে না। এ ব্যাপারে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দিলে সেটি নগরসেবার উন্নয়নে একটি ইতিবাচক ধাপ হিসেবেই গণ্য হবে।

সিটি করপোরেশন মশকনিধন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঠিকভাবে করতে পারে না, এখন নতুন দায়িত্ব পেলে তারা সামাল দিতে পারবে কি না—এই প্রশ্নে ইকবাল হাবিব বলেন, যে ফাঁকিবাজ, তাকে দায়িত্ব কমিয়ে দিলেও ফাঁকিবাজি করবে।