ভবনই শেষ হয়নি, যন্ত্র কেনা সারা

ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করার দেড় বছর আগে ৭৪ কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হয়েছে। পশু জবাই হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে।

জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কিশোর–যুবকেরা করছেন পশু জবাইয়ের কাজ। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে
ছবি: প্রথম আলো

দুটি আধুনিক পশু জবাইখানার জন্য প্রায় ৭৪ কোটি টাকার যন্ত্র এনে ফেলে রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কারণ, যে ভবনে পশু জবাই করা হবে, তার নির্মাণকাজই এখনো শেষ হয়নি। কবে ভবন দুটির নির্মাণকাজ শেষ হবে, সেটিও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ।

অথচ মেয়রের দায়িত্ব ছাড়ার আগে তড়িঘড়ি করে গত ২৪ মার্চ হাজারীবাগের জবাইখানাটিতে একটি গরু জবাই করে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ভবনটির সামনের দেয়ালে খোদাই করা শ্বেতপাথরে নিজের নাম লিখে (নামফলক) যান তিনি। ওই দিনের পর আর একবারও সেখানে পশু জবাই হয়নি। যন্ত্রগুলো প্লাস্টিকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাঈদ খোকন মেয়রের দায়িত্ব ছেড়েছেন গত ১৫ মে।

ভবনের নির্মাণকাজ শেষ না হলেও দুটি জবাইখানার জন্য ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে চীন থেকে যন্ত্রপাতি আনা হয়। হাজারীবাগের নির্মাণাধীন ভবনে যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। আর কাপ্তানবাজারের জন্য আনা যন্ত্র গুদামে রয়েছে। হাজারীবাগের যন্ত্রের দাম প্রায় সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। আর কাপ্তানবাজারের যন্ত্রের দাম প্রায় ৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর দুটি জবাইখানার জন্য নেওয়া প্রকল্পের মোট ব্যয় (ভবন নির্মাণসহ) ১৩৩ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই আশঙ্কা করছেন, মরিচা পড়লে যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে যেতে পারে।

হাজারীবাগে জবাইখানার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছরের জুনে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।

কাপ্তানবাজারে জবাইখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। সেখানে ভবনের নির্মাণ অগ্রগতি আরও কম। গত জুনে এটি চালু হওয়ার কথা ছিল। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ।

ঢাকায় দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার পশু জবাই হয়। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, মাংস ব্যবসায়ীরা এখন যেখানে ইচ্ছা সেখানেই জবাই করেন। কারণ, সিটি করপোরেশনের কোনো জবাইখানা নেই।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালের প্রধান ভেটেরিনারি কর্মকর্তা আফাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, জবাইয়ের আগে অবশ্যই পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। অসুস্থ পশু জবাই হলে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত এবং যাঁরা এ মাংস খাবেন, তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবে। জলাতঙ্কসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে।

হাজারীবাগের চিত্র

হাজারীবাগের গজমহল এলাকায় গত ২০ সেপ্টেম্বর গিয়ে দেখা যায়, জবাইখানার ভবনের চারতলা পর্যন্ত ছাদ নির্মিত হয়েছে। ভবনের ভেতরে সিঁড়িতে টাইলস বসানো, মেঝের ফিনিশিংয়ের কাজ, রং করা, সিঁড়িঘরের জানালায় গ্লাস বসানো ও পশু ওঠানোর পথের আনুষঙ্গিক কাজ বাকি।

জবাইখানাটি নির্মাণকাজের সময় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ব্যয়ও। শুরুতে এটি নির্মাণের ব্যয় (ভবনসহ) ধরা হয়েছিল ৭০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরে ব্যয় প্রায় ১১ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। নির্মাণকাজের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডিএসসিসির অঞ্চল-৩ (আজিমপুর)-এর প্রকৌশলীরা বলছেন, পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণের পর তাঁরা বুঝতে পারেন যে আগের বরাদ্দকৃত টাকায় পুরো কাজ সম্ভব নয়। এ জন্য মেয়রের (সাঈদ খোকন) অনুমোদনে ব্যয় বাড়ানো হয়।

কাপ্তানবাজারের পরিস্থিতি

কাপ্তানবাজারের জবাইখানায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর গিয়ে কোনো শ্রমিককে নির্মাণকাজ করতে দেখা যায়নি। এখানে ভবন হওয়ার কথা দ্বিতল। ছাদ ও পিলারের কাজ হয়েছে, ভবনের দেয়াল নির্মাণের পুরো কাজ শেষ হয়নি। ডিএসসিসি বলছে, মুরগি ব্যবসায়ীদের দখল থেকে জমি উদ্ধার করতে জটিলতার কারণে জবাইখানাটির কাজ শুরু করতে দেরি হয়। বর্তমানে এ প্রকল্পের পরিচালক মুন্সী মো. আবুল হাসেম বলেন, বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দুটি জবাইখানার নির্মাণকাজ হয়েছে। তখন প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। নতুন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পরদিনই তাঁকে চাকরিচ্যুত করেন। আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

পাঁচ জবাইখানা

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পাঁচটি পশু জবাইখানা রয়েছে। দক্ষিণে দুটি এবং উত্তরে তিনটি। নিয়ম হচ্ছে, বাজারে মাংস বিক্রির আগে করপোরেশন নির্ধারিত জবাইখানা থেকে পশু জবাই করে নিতে হবে। পশুর গায়ে করপোরেশনের সিল থাকবে। জবাইয়ের আগে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। কিন্তু এসব নিয়ম মানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ পশু জবাইয়ের জায়গা অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা।

দক্ষিণ সিটির ভেটেরিনারি কর্মকর্তা এ বি এম শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের আওতাধীন দুটি পশু জবাইখানা (কাপ্তানবাজার ও হাজারীবাগ) আধুনিকায়নের কাজ চলছে। তাই তাঁরা পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ যেসব ব্যবস্থাপনার কথা ছিল, তা করতে পারছেন না।

উত্তর সিটি বলছে, তিনটি পশু জবাইখানায় ছাগলের জন্য ১০ টাকা, গরুতে ৫০ ও মহিষে ৭৫ টাকা ফি দিতে হয়। দক্ষিণ জবাইখানা আধুনিকায়নের কাজ চলায় ফি নেওয়া হচ্ছে না।

‘সিলম্যান শুধু সিল মারেন’

ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আওতাধীন মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট কাঁচাবাজারের জবাইখানায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ছয়টায় গিয়ে সিটি করপোরেশনের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভেতরে ততক্ষণে দুটি গরু জবাই হয়েছে। কয়েকজন কিশোর-যুবক চামড়া ছাড়ানোর কাজ করছিলেন। তাঁদের একজন রমজান আলী বলেন, পশু জবাইয়ের পর সিটি করপোরেশনের সিলম্যান গিয়ে মাংসে সিল মেরে চলে যান। কিন্তু কী দেখে সিল মারেন, সেটা তিনি জানেন না।

তবে ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার জানান, জনবলসংকট থাকলেও তাঁদের আওতাধীন তিনটি জবাইখানায় পশু নিয়ে এলে তাঁরা সেবা দিতে পারবেন। পরিবহন খরচ বাঁচাতে মাংস ব্যবসায়ীরা করপোরেশনের নির্ধারিত জবাইখানায় পশু আনতে চান না।

২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ছয়টার দিকে ওই জবাইখানায় গাবতলী থেকে আরও চারটি গরু নিয়ে আসেন দুজন মাংস ব্যবসায়ী। তাঁরা জানান, চারটির মধ্যে দুটি জবাই হবে। নিয়ম অনুযায়ী, জবাইয়ের জন্য কমপক্ষে এক দিন আগে পশু জবাইখানায় নিয়ে আসতে হয়। ভেটেরিনারি চিকিৎসক আগের দিনই পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। শারীরিক কোনো জটিলতা কিংবা অসুস্থতা না থাকলে এক দিন পর পশু জবাই করা যায়।

ওই দিন সকাল সাতটায় মহাখালী কাঁচাবাজারের পশু জবাইখানায় গিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। মহাখালীতে করোনা আইসোলেশন সেন্টার চালু হওয়ার পর থেকেই ওই জবাইখানায় কোনো পশু আনা হয় না বলে জানান নিরাপত্তাকর্মী।

পশু জবাইখানার জন্য ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই যন্ত্র কেনাকে ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার সঙ্গে তুলনা করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কাজে গাফিলতি বা দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।