মারা গেছে শুনে পালায় সবাই, রাসেল এসে বলেন ‘ও ঘুমাচ্ছে’

আবরার ফাহাদ
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে মৃত ঘোষণাকারী চিকিৎসক মাসুক এলাহী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আজ রোববার তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।

বেলা ১১টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা মামলার শুনানি চলে। বুয়েট মেডিকেল সেন্টারের সহকারী প্রধান মাসুক এলাহী। তাঁকে নিয়ে এই মামলায় পাঁচজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলো। কাল সোমবার এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

চিকিৎসক মাসুক এলাহী আদালতকে বলেন, গত বছরের ৭ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টা ৪৭ মিনিটের দিকে বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে জরুরি নম্বরে একজন ফোন দেন। বলেন, ওই হলের এক ছাত্র অসুস্থ। তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের চালককে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে শেরেবাংলা হলের উত্তর ফটকে যান। তখন হলের ১০-১৫ জন ছাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি ঘিরে ধরেন। তাঁকে দ্রুত অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং স্ট্রেচার আনতে বলেন।

ওই ছাত্রদের উদ্দেশ্যে মাসুক এলাহী তখন বলেন, আগে তিনি রোগী দেখবেন, তারপর যা করার করবেন। ছাত্ররা তাঁকে হলের উত্তর ব্লকের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যান। সেখানে একটি তোশকের ওপর আবরার ফাহাদকে দেখতে পান তিনি। তাঁর পরনে ছিল একটি ফুল হাতা শার্ট ও ট্রাউজার। তোশক ও ট্রাউজার মূত্রে ভেজা ছিল। আবরারের যে লক্ষণ দেখতে পান, তা ছিল একজন মৃত মানুষের। তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ ছিল। হৃদ্‌যন্ত্র বন্ধ ছিল। কোনো রক্তচাপ ছিল না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন।

সাক্ষ্যে চিকিৎসক মাসুক এলাহী বলেন, আবরারকে মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ১০-১৫ জন ছাত্র দ্রুত পালিয়ে যান। আবরারের লাশের পাশে ছিলেন কেবল তিনিই। কিছুক্ষণ পর একজন সেখানে আসেন। তাঁর নাম রাসেল। নিজেকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ‘সেক্রেটারি’ পরিচয় দেন। রাসেল তাঁকে বলেন, ‘ও ঘুমাচ্ছে। মারা যায়নি। কিছুক্ষণ আগে আমাদের সঙ্গে আবরার কথা বলেছে।’ আবরারকে ঢাকা মেডিকেলের নেওয়ার জন্য তাঁকে (চিকিৎসক) চাপ দিতে থাকেন রাসেল। তখন রাসেলকে তিনি বলেন, আবরার মারা গেছে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে কোনো লাভ নেই।

মাসুক এলাহী এরপর আবরারের মৃত্যুসংবাদ হলের প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খানকে জানান। ফোন দেওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে প্রভোস্ট চলে আসেন। ততক্ষণে রাসেলের নির্দেশে আবরারের লাশ নিচতলায় হলের বারান্দায় এনে রাখা হয়। তখন তিনি চাদর দিয়ে আবরারের লাশ ঢেকে দেন। হলের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ রাত চারটার দিকে হলে আসে। হলের ক্যানটিনে আবরারের লাশের সুরতহাল করে পুলিশ। সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। লাশের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ওই চিকিৎসকও।

সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হলে মাসুক এলাহীকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। তাঁদের বেশির ভাগই জানতে চান, কী কী লক্ষণ দেখে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন বুয়েটের ওই চিকিৎসক। জবাবে মাসুক এলাহী বলেন, একজন মৃত মানুষের যতগুলো লক্ষণ থাকে, তার সবই ছিল আবরারের। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আবরারের এই অবস্থা কী করে হলো, উপস্থিত ছাত্ররা কিছুই তাঁকে জানাননি। বিষয়টি জানতে চাইলে সবাই চুপ ছিলেন। আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রাসেলকে (পুরো নাম মেহেদী হাসান) শনাক্ত করেন মাসুক এলাহী।

আসামি পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী মাহাবুব আহমেদ, আমিনুল গনী টিটো, আজিজুর রহমান প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করছেন বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজী ও আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া।

গত বছরের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে উদ্ধার হয় তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ। এ ঘটনায় করা মামলায় গত বছরের ১৩ নভেম্বর বুয়েটের ২৫ ছাত্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত ২১ জানুয়ারি অভিযোগপত্রটি আমলে নেন আদালত। তিন আসামি পলাতক রয়েছেন।