মৌসুম শেষে রোগী বাড়ছে

  • গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে ১০ জন হাসপাতালে ভর্তি।

  • জুন থেকে সেপ্টেম্বর—চার মাসে আক্রান্ত ১৫৮ জন

গরমের পর কয়েক দিন বৃষ্টি হয়েছে। এতে জমে থাকা পানিতে মশাও বাড়ছে। মশার উপদ্রবে টিকতে না পেরে দিনের বেলায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমাচ্ছেন এক ব্যক্তি। গত সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই সময়ে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। এবার ডেঙ্গুর মূল মৌসুমে রোগীর সংখ্যা ছিল কম। করোনার কারণে ডেঙ্গুর বিষয়টি অনেকটা আড়ালে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে ১০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর গত এক সপ্তাহে সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৫৯৫ জনের। গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত ২৮ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আর চলতি বছর ডেঙ্গুতে সন্দেহে ৪ জনে মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত দুটি মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে একটি ঘটনায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে।

জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে ৫৯৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত। এর মধ্যে গত সাত দিনে আক্রান্ত ৫৫ জন।

খিলক্ষেত ব্যাপারীপাড়ার বাসিন্দা শাহিনুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পরে মশার যন্ত্রণায় কোথাও বসা যায় না। মশার ওষুধ ছিটাতেও দেখা যায় না।

সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর একটি হাসপাতালে জাহিদুর রশীদ নামের এক চিকিৎসক ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর তথ্যও পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাসওয়ারি ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩১ জন। অথচ এর আগে জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাসে (ডেঙ্গুর মূল মৌসুম) ১৫৮ জন আক্রান্ত হয়েছিল।

ডেঙ্গুর মূল মৌসুম পর হওয়ার পর হঠাৎ ডেঙ্গু রোগী বাড়ার কারণ কী, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না বলে জানান ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগের বছরের চেয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কিছুটা ভালো হয়েছে। গত কয়েক দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার উপদ্রব বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ লোক প্রাণ হারান। আর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯।

এবার দেশে করোনা প্রকোপের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী সেভাবে বাড়েনি। তবে হঠাৎ রোগী বাড়তে শুরু করেছে। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখনো উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো হয়নি। মশকনিধনের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রয়োজনে বিশেষ কার্যক্রম চালানো হবে।

বছরের শুরু থেকেই উড়ন্ত মশা মারার ওষুধের সংকটে পড়ে ডিএসসিসি। উত্তর সিটির কাছ থেকে ৫০ হাজার লিটার ওষুধ ধার নিয়ে কাজ চালায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মূলত বিদেশ থেকে আনা ম্যালাথিউন ওষুধের সঙ্গে কেরোসিন বা ডিজেল এবং অন্য উপাদান মেশাতে না পারায় সংকট তৈরি হয়। এই মিশ্রণ তৈরির জন্য একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করে সংস্থাটি। দীর্ঘ ১০ মাস পরে সংস্থাটি নিজের ওষুধ ব্যবহার শুরু করেছে।

ডিএসসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মীর মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগের মাসগুলোর তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় গত রোববার বিশেষ সভা করা হয়েছে। যেসব এলাকায় মশার লার্ভা বেশি, সেসব জায়গায় অভিযান চালানো হবে। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় অক্টোবর মাসে রোগী বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই মাসের মাঝামাঝি থেকে উত্তর সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে বড়ির মতো ওষুধ নোভালুরন ব্যবহার শুরু করেছে। মশার প্রজনন ও বংশবিস্তার উপযোগী উত্তর সিটির ৬২৯টি জায়গায় এ ওষুধ প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ওষুধের কারণে মশার লার্ভা খোলস বদলাতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যায়। একেকটি নোভালুরন বড়ির কার্যকারিতা প্রায় ৯০ দিন। অতীতে ব্যবহৃত ওষুধগুলো ছিল তরল, যা স্প্রে মেশিন ব্যবহার করে দু-তিন দিন পরপর ছিটাতে হতো।

মশার বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার অক্টোবর মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এতে মশার ঘনত্ব অনেক বেড়েছে। সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু রোগী যতটা কম বলা হচ্ছে, তা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছে না। করোনার কারণে অনেক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে যাননি, এখন করোনাভীতি কমে আসায় ডেঙ্গু রোগীর বিষয়টি সামনে আসছে।