রামচন্দ্র কখনো ভাবেননি জীবন এতটা দুর্বিষহ হবে

৪৭ বছর আগে জুরাইনে ঘড়ি ঠিক করার যে পেশা বেছে নিয়েছিলেন, আজও সেই পেশাতেই আছেন রামচন্দ্র দাস
ছবি: প্রথম আলো

কিশোর বয়স থেকে নিজের আয়ে চলা রামচন্দ্রের দুর্বিষহ এক জীবন কাটছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। করোনায় গেল বছরের মার্চ মাস থেকে টানা সাধারণ ছুটিতে জনজীবন যখন স্থবির, তখন রামচন্দ্রের জীবনও ভালো কাটেনি। টানা ছয় মাস বেকার ছিলেন। একটি টাকাও তাঁর আয় ছিল না। তাই সংসার চালাতে গিয়ে পরিচিত মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছে। ঋণ করেন ৩০ হাজার টাকা।

রামচন্দ্র দাস ফিরে যান ছোটবেলায়, যখন বয়স ছিল ১৪ বছর। পড়তেন অষ্টম শ্রেণিতে। অবশ্য পড়ার ফাঁকে যতটুকু সময় পেতেন, জুরাইন মোড়ের একটি ঘড়ি মেরামতের (ঘড়িমেকার) দোকানে গিয়ে বসে থাকতেন। দেখতেন কীভাবে ঘড়ির মেকার নষ্ট ঘড়ি ঠিক করে ফেলছেন। দুই বছর ঘড়িমেকারের দোকানে সময় দিয়ে নিজে ঘড়ি সারানোর বিষয়টি ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেন। হয়ে যান একজন ঘড়িমেকার।

দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা রামচন্দ্র দাস অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার পর আর লেখাপড়া করেননি। ৪৭ বছর আগে জুরাইনে ঘড়ি ঠিক করার যে পেশা তিনি বেছে নিয়েছিলেন, আজও সেই পেশাতেই তিনি আছেন।

সময়ের ব্যবধানে কিশোর ঘড়িমেকার রামচন্দ্র এখন ৬১ বছরের এক বৃদ্ধ মানুষ। চোখের জ্যোতি কমেছে। চশমাবিহীন চোখে কাজ করতে পারেন না। তাই মোটা ফ্রেমের চশমা এখন নিত্যসঙ্গী।

৪৭ বছরের ঘড়িমেকারের জীবনে ৩৪ বছর কেটেছে জুরাইনের মোড়ে। বাকি ১৩ বছর মতিঝিলের ফুটপাতে। আছে তাঁর ছোট্ট একখানা টেবিল। টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে ঘড়ি সারানোর নানা যন্ত্রাংশ আর পুরোনো কিছু ঘড়ি।

ঘুম থেকে উঠে গোসল, খাওয়াদাওয়া শেষে চলে আসেন মতিঝিলে। দিনভর কাজ শেষে সন্ধ্যার পর আবার ফিরে যান জুরাইনের ভাড়া বাসায়। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের ছয় দিনই রামচন্দ্র চলে আসেন মতিঝিলে।

হাতঘড়ির যখন স্বর্ণযুগ, তখন কাজ পেতেন ভালো। দিনভর কাজ শেষে আয় হতো ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। সেই আয় দিয়ে সংসার চালিয়েছেন রামচন্দ্র। তাঁর তিন মেয়ে, দুই ছেলে। ঘড়ি মেকারির টাকায় তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে এখন অনার্সে পড়ছেন। আরেক ছেলে বেশি দূর লেখাপড়া করেননি। বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। কাজ করেন একটি কারখানায়।

রামচন্দ্র দাসের ঘড়ির দোকান।
ছবি: প্রথম আলো

কিশোর বয়স থেকে নিজের আয়ে চলা রামচন্দ্রের দুর্বিষহ জীবন কাটছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। করোনায় গেল বছরের মার্চ মাস থেকে টানা সাধারণ ছুটিতে জনজীবন যখন স্থবির, তখন রামচন্দ্রের জীবনও ভালো কাটেনি। টানা ছয় মাস বেকার ছিলেন। একটি টাকাও তাঁর আয় ছিল না। তাই সংসার চালাতে গিয়ে পরিচিত মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছে। ঋণ করেন ৩০ হাজার টাকা। রামচন্দ্র বলেন, এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে হবে, কখনো ভাবেননি।

রামচন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা আসার পর নিজের কাজকর্ম ছিল না ছয়-সাত মাস। মার্চের পর থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারিনি। পরিচিত দুই স্যারের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়েছিলাম। আর মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালাইতে হয়েছে। ধার করেছিলাম ৩০ হাজার টাকা। ডাল-ভাত খেয়ে কোনো রকম বেঁচে ছিলাম। তখন তো করোনায় সারা বিশ্বের অবস্থা খারাপ। আমার অবস্থা ভালো হবে কেমনে?’

রামচন্দ্রের আফসোস

রামচন্দ্রের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে। তবে জন্ম পুরান ঢাকার লালবাগে। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন দিনমজুর। রামচন্দ্ররা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। এক ভাই আর এক বোন মারা গেছেন। অন্য সবাই ঢাকায় থাকেন। দিনমজুরি করে ১০ ভাইবোনকে বড় করতে গিয়ে হিমশিম খান রামচন্দ্রের বাবা। ভালো ছাত্র হয়েও অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করেননি। তখন নিজের ইচ্ছাতে কিশোর বয়সে ঘড়ি সরাইকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

রামচন্দ্রের ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি, সময়ের ব্যবধানে ঘড়িমেকারের কদর কমবে। রামচন্দ্র যখন এ পেশা বেছে নেন, তখন ছিল হাতঘড়ির যুগ। বাজারে তখন সিকো-৫, রাডো, রিকো, ওরিয়েনের জয়জয়কার। অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষের হাতে শোভা পেত এসব দামি ঘড়ি। এসব ঘড়ি পাওয়া যেত ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে।

মানুষের হাতে শোভা পাওয়া সেসব অ্যানালগ ঘড়ি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে সহজে তা ঠিক করা যেত। তবে সময়ের ফেরে অ্যানালগ ঘড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছে ডিজিটাল ঘড়ি। এতে বিপদে পড়ে গেছেন তিনি।
রামচন্দ্র বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমরা থাকি জুরাইনে। জুরাইন মোড়ে একটা ঘড়ির দোকান ছিল। সেই ঘড়ির দোকানে একজন মেকার ছিলেন। সেই দোকানে আমি যেতাম। দুই বছর ধরে সেই দোকানে আমি সময় দিয়েছি। কীভাবে ঘড়ি ঠিক করে, সেই কাজ আমি ভালোভাবে শিখে ফেলি।

আমাদের অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। পরিবারের এমন অবস্থা দেখে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জুরাইন মোড়ে ঘড়ি ঠিক করার কাজ শুরু করি। তখন তো অ্যানালগ ঘড়ির রমরমা অবস্থা। ভালো আয় হয়। পরে বিয়ে করি। দিব্যি ভালো চলছিলাম। তখন তো আমার মনেই হয়নি, অ্যানালগ ঘড়ির ব্যবহার একেবারেই কমে যাবে। এখন তো অ্যানালগ ঘড়ি কেউ হাতে পরেন না বললেই চলে। আমরা অ্যানালগ যুগের মানুষ। এখন তো ডিজিটাল যুগ। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। ঘড়ি আর কয়জনই–বা পরেন? তবু অফিস-আদালতে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো অ্যানালগ ঘড়ি পরেন। এসব ঘড়ি নষ্ট হলে আমার কাছে আসেন। ঠিক করে দিই। এই কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি।’

কিশোর বয়সে ঘড়ি মেরামতে হাতপাকানো রামচন্দ্র জীবনে বহু মানুষ দেখেছেন, যাঁরা ঘড়ি মেরামতের পেশায় কিছুদিন থেকে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অনেকে ব্যবসা করে ঢাকায় জমি কিনেছেন, ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। মানুষের এমন উন্নতি দেখে মাঝেমধ্যে রামচন্দ্রের আফসোস হয়, কেনই–বা তিনি এই পেশায় এত বছর থেকে গেলেন?
ঘড়ি মেরামতের কাজ করে ৪৭ বছর আগেও ঢাকা মহানগরের জুরাইনে যে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়েছে, এখনো সেই ভাড়া বাসাতেই থাকতে হয়। জুরাইনে ছোট্ট একটা বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। মাস গেলে ভাড়া গুনতে হয় চার হাজার টাকা। চাল, ডাল, তেলসহ সংসারের সব খরচ মিলিয়ে রমাচন্দ্রের মাসে ব্যয় ২০ হাজার টাকা।

ডিজিটাল ঘড়ির যুগে অ্যানালগ ঘড়ির কাজ শেখা রামচন্দ্রের তাই রোজ সময় কাটে দুশ্চিন্তায়। শরীরে এখনো বড় ধরনের কোনো ব্যাধি সঙ্গী হয়নি। তবে বয়স হয়ে যাওয়ায় শরীর আর আগের মতো চলে না। ঘড়ি সারানোর কাজ থেকে অবসর নিতে মন চায়। কিন্তু অবসর মিলবে কীভাবে?

রামচন্দ্র দাস।
ছবি: প্রথম আলো

ছোট ছেলের লেখাপড়া শেষ হয়নি। বড় ছেলের আলাদা সংসার। ঘড়ি সারিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার খরচ মেটাতে হয়। ছোট ছেলের লেখাপড়া শেষে যদি একটা চাকরি মেলে, আয় করা শেখে, তখন হয়তো রামচন্দ্র সত্যি সত্যিই অবসরে যাবেন।

রামচন্দ্র বলেন, ‘জীবন তো একটা যুদ্ধ। আমি কাজ করি, মানুষের ঘড়ি ঠিক করে দিই, বিনিময়ে মানুষ আমাকে পয়সা দেয়। আমি যখন ঘড়ি ঠিক করতে পারব না, তখন তো আমাকে কেউ এক পয়সাও দেবে না। আর ঘড়ি সারানোর কাজ করে সঞ্চয় তো কিছু করতে পারিনি। যা আয় করি, তা খরচ হয়ে যায়। আর করোনা তো আরও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। গেল বছর বসে ছিলাম ছয় মাস, এ বছরও লকডাউনে এক মাস সেভাবে কাজও হয়নি।’

রামচন্দ্র ঝুটঝামেলার জীবন চাননি বলেই ঘড়ি মেরামতের মতো কাজ শিখে এ পেশায় এসেছিলেন। যত দিন বাঁচবেন, যত দিন কর্মক্ষম থাকবেন, তত দিন রামচন্দ্র ঘড়ি সারানোর কাজটি করে যাবেন।

রামচন্দ্র বলেন, ‘মানুষের ঘড়ি ঠিক করে জীবন কেটে গেছে। এখন তো জীবনের শেষবেলা। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন কাজ করে ডাল-ভাত খেতে চাই। এটাই আমার চাওয়া।’