রেনুকে পিটিয়ে হত্যা মামলার আসামি ১৫ জন

  • গ্রেপ্তার ১৪, একজন পলাতক

  • পাঁচ আসামি জামিনে, কারাগারে নয়জন

  • আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনজন

প্রতীকী ছবি

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর ১৫ জনকে আসামি করে তাসলিমা বেগম ওরফে রেনু হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। গত বছরের ২০ জুলাই বাড্ডায় স্কুল প্রাঙ্গণে ছেলেধরা গুজবে তাসলিমা বেগম ওরফে রেনুকে (৪০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

আলোচিত ওই হত্যা মামলার অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি আজ প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি-মতিঝিল) উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, হত্যায় মোট ১৯ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও চারজনের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া গেলে পরে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজ দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক আবদুল হক ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তাসলিমা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেন।

তাসলিমা বেগম ওরফে রেনু
ফাইল ছবি

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ১৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক। প্রাপ্তবয়স্করা হলেন- রিয়া বেগম, হৃদয় ইসলাম মোল্লা ওরফে ইব্রাহীম ওরফে নয়ন মোল্যা, মো. বাপ্পী, সোহেল রানা, মো. বিল্লাল, আসাদুল ইসলাম, মো. রাজু, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন, বাচ্চু মিয়া, মো. শাহীন, মুরাদ মিয়া ও মো. মহিউদ্দিন। এদের মধ্যে মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পাঁচ আসামি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তারা হলেন- রিয়া বেগম ওরফে ময়না (২৭), মো. বাচ্চু মিয়া, মুরাদ মিয়া, মো. শাহীন ও মো. বাপ্পী। এখন পর্যন্ত নয়জন কারাগারে আছেন। এ নিয়ে মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন রিয়া বেগম, হৃদয় ইসলাম ও জাফর হোসেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আদালতে জবানবন্দি দেওয়া রিয়া বেগম সেদিন ঘটনার উসকানি দিয়েছিলেন। হৃদয় ইসলাম মামলার প্রধান আসামি। তিনি স্কুলের পাশে সবজি বিক্রি করতেন। তিনিই তাসলিমাকে প্রথমে লাঠিপেটা করেন। আর জাফর প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দেওয়ালের সঙ্গে আঘাত করতে থাকেন।

গত বছরের ২০ জুলাই সকালে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা তাঁর চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে যান। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাঁকে ‘ ছেলেধরা’ সন্দেহ করেন। এই গুজব দ্রুত বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশ থেকে বিভিন্ন বয়সী কয়েক শ নারী-পুরুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে তাসলিমাকে স্কুলের দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। কিন্তু কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ কলাপসিবল গেট ভেঙে দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে তাসলিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে এনে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে থাকে, পেটায় লাঠি দিয়েও । এভাবে আধ ঘণ্টা অমানবিক নির্যাতনের পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাসলিমা। তাসলিমার ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন ওই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছিলেন।

গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাসলিমা হত্যা মামলার তদন্তভার পায়। তখন তদন্ত সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাসলিমা হত্যায় ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন বয়সের অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছেন তারা।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক আবদুল হক আজ প্রথম আলোকে জানালেন, সেদিনের ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবিতে ঘটনাস্থলে অনেককেই দেখা গেছে। কিন্তু এতে সবার জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ মেলেনি। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। একজন পলাতক আছেন। বাকি চারজনের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

নিহত তাসলিমা ইডেন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছিলেন। পরে তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। বিয়ের পর তিনি আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেন। বড় ছেলের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তাসলিমা বছর তিনেক আগে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করানোর পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

তিন বছর আগে তাসলিমার সঙ্গে তাঁর স্বামী তসলিম হোসেনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন ছেলে থাকত বাবার কাছে এবং মেয়ে থাকত মায়ের কাছে। তাসলিমাকে হত্যার পর মেয়েকে তার বড় খালার বাসায় নিয়ে আসা হয়।

মামলার বাদী তাসলিমার ভাগনে নাসিরউদ্দিন ওরফে টিটু আজ রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্রে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ডিবি মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর ৫০ জন জড়িত থাকার কথা বলেছিল। কিন্তু অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৫ জনের। এতে মামলা দুর্বল হতে পারে।

নাসিরউদ্দিন বলেন, হত্যাকাণ্ডে স্কুলশিক্ষকেরা দায় এড়াতে পারেন না। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তিনি।