লকডাউনে যেভাবে ঢাকায় এলেন অপিয়ার

লকডাউনের মধ্যে নীলফামারীর জলঢাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন অপিয়ার ও তাঁর চাচাতো ভাই।
ছবি: মো. মিজানুর রহমান

এক মাস ঢাকায়, আর এক মাস গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন নীলফামারী জেলার জলঢাকার অপিয়ার। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ও জানতেন না ঢাকায় পৌঁছাতে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা যাত্রাপথে কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।

ঢাকায় পৌঁছাতে অপিয়ারকে চড়তে হয়েছে ভ্যান, বাস ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। পুরো পথে এক যানবাহন থেকে নেমে অন্য যানবাহনে ওঠার জন্য কয়েকবার হেঁটেছেন। তা ৮–১০ কিলোমিটার হবে। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ পাঁচ শ টাকার খরচ হলেও এবার প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাঁর। প্রতিটি জায়গার পরিবহনই তাঁর কাছ থেকে দ্বিগুণ বা বেশি ভাড়া আদায় করেছে। সময় লেগেছে ১৭ ঘণ্টার বেশি।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর এই দীর্ঘ সময়ে একবার সামান্য খাবার ও পানি ছাড়া তেমন কিছু খাননি। বুধবার ১টা ৩৫ মিনিটের সময় আমিনবাজার সেতুর ওপর ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত ও অভুক্ত অপিয়ারের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন তাঁর চলার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে প্রায়।
আমিনবাজারে বাস থেকে নামার পর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছেন অপিয়ার। কারণ, এই পথ রিকশায় চড়ার জন্য টাকা ছিল না তাঁর পকেটে। বাড়ি থেকে যে টাকা নিয়ে বের হয়েছেন, প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় ৯ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। বাস, ট্রেন ও নৌযান বন্ধ থাকায় সারা দেশের সঙ্গে মূলত বিচ্ছিন্ন রয়েছে রাজধানী ঢাকা। টেলিভিশনের খবরে লকডাউনের বিষয়টি শুনলেও সাত জেলার জন্য বিধিনিষেধ এবং অন্য জেলার গণপরিবহনের ব্যাপারে শিথিলতা থাকায় ঢাকায় আসতে পথের বিড়ম্বনার বিষয় আন্দাজ করতে পারেননি অপিয়ার।

ঢাকার মিরপুর-১ নম্বরের একটি রিকশার গ্যারেজে থাকেন অপিয়ার। চাচাতো ভাই আশরাফকে সঙ্গে নিয়ে রাত আটটায় বাড়ি থেকে ভ্যানে করে জলঢাকা বাসস্ট্যান্ডে আসেন। আশরাফও এখন থেকে তাঁর সঙ্গে রিকশা চালাবে। বাসস্ট্যান্ডে আসার পর দুজনে মিলে টিকিট কাটেন (জনপ্রতি ভাড়া ৭০০ টাকা) রিশা পরিবহনের। টিকিট নেওয়ার পর বাসের হেলপার তাঁদের লকডাউনের বিষয়টি জানান। রাত ১০টায় জলঢাকা থেকে ছেড়ে আসার পর এলেঙ্গায় এনে তাঁদের নামিয়ে দেয় গাড়িটি।

অপিয়ার বলেন, ‘রিশা পরিবহন এলেঙ্গায় এনে নামিয়ে দেয়। এখান থেকে সামনের দিকে আসার কোনো বাস নেই। অন্য উপায় না থাকায় জনপ্রতি এক শ টাকা দিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চন্দ্রায় আসি। রিকশাচালকেরা যাঁর কাছ থেকে যেমন খুশি ভাড়া নিচ্ছেন, মানুষকে প্রায় জিম্মি করে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন।’

অপিয়ার বলেন, তাঁদের মতো আরও অনেকেই বিভন্নভাবে ঢাকায় আসার চেষ্টা করছিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টার পর চন্দ্রা থেকে একটি বাসে (বাসের নাম বলতে পারেননি) উঠতে পারলেও কিছুদূর আসার পর পুলিশ বাস থেকে সব যাত্রী নামিয়ে দেয়। বাসের হেলপার-ড্রাইভার তাঁদের কিছু দূর হেঁটে সামনে যেতে বলেন। এক কিলোমিটারের বেশি পথ হাঁটিয়ে পুনরায় তুলে নেন। এই বাসে (ভাড়া ৪০ টাকা) আমিনবাজারে এসে নামি।

অপিয়ার বলেন, ‘দেশে তো (জলঢাকায়) কোনো কাজ নাই, তারপরেও এত কষ্ট আর টাকা খরচ হবে জানলে আসতাম না।’

২৫ বছর বয়সের অপিয়ার দুই সন্তানের জনক। সন্তানেরা ছাড়াও স্ত্রী, মা–বাবা ও ছোট ভাই থাকেন গ্রামের বাড়িতে। আগে নানা কাজ করলেও বেশ কয়েক বছর রিকশা চালান। আয় করেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অপিয়ার বলেন, ‘ঢাকায় আসতে এমন অবর্ণনীয় কষ্ট আর কখনো করেছি কি না মনে পড়ে না।’