লক্কড়ঝক্কড় ১৩ নম্বর লাভে, বিআরটিসির এসি বাস লোকসানে

ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মানুষকে সেবা দিতে চালু হয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চক্রাকার এসি বাস। ২০১৯ সালের মার্চে রাজধানীর কয়েকটি রুটে চালু হওয়া এই সেবাটি জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল বেশ। তবে তিনটি রুটে চালু হওয়া এসব বাস এখন লোকসানের মুখে।

বিআরটিসির এ–সংক্রান্ত হিসাবের কিছু নথি পেয়েছে প্রথম আলো। নথিগুলোতে দেখা যায়, বন্ধের আগে ২০২০ সালের শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে মোহাম্মদপুর-আজিমপুর রুটে চলা একটি বাসের (৪৮১৩ অশোক-এসি) মাসিক মোট আয় ১,৭৬,৪৪৫ টাকা। আর খরচ দেখানো হয়, জ্বালানি ১,১৮,১২৬ টাকা, যন্ত্রাংশ ৬,৫০০ টাকা, মেরামত ৬,৭৪০ টাকা, বেতন–ভাতা ৬৯,১৮২ টাকা, অন্যান্য ৪,৩৩১ টাকা। নথিতে মোট ব্যয় দেখানো হয় ২,০৪,৮৭৯ টাকা। এই হিসাবে মোট ক্ষতি দেখানো হয় ২৮,৪৩৪ টাকা। এভাবে এই রুটে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোট লোকসান দেখানো হয় ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকার বেশি।

ওই বছরই মার্চের ২৬ তারিখ লকডাউনের আগে মাত্র ২৫ দিনে এই রুটে বিআরটিসি লোকসান দেখিয়েছে প্রায় দ্বিগুণ—৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ সময়ে ৯৪ হাজার টাকা আয়ের বিপরীতে জ্বালানি খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বেতন ও অন্যান্য খাতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচের পর এ লোকসান হয়। বিআরটিসি বলছে, চক্রাকার বাসের অন্যান্য রুটেও লোকসান হয়েছে।
এক বছর সেবাটি চলার পরই করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা বলে চক্রাকার বাসের সেবা বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে এলে একটি রুট ছাড়া অন্যান্য রুটে এখনো চালু হয়নি বিআরটিসির চক্রাকার বাসের সেবা।

বিআরটিসি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থেকে নিউমার্কেট হয়ে আজিমপুর রুটে চলে আটটি এসি বাস। আর উত্তরা থেকে বনানী, গুলশান–২, কুড়িল বিশ্বরোড হয়ে চলে পাঁচটি এসি বাস। এ ছাড়া সদরঘাট থেকে দয়াগঞ্জ মোড়, যাত্রাবাড়ী হয়ে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত চলে একটি দ্বিতল বাস।

চলতি মাসে উত্তরা রুটের সেবাটি চলাচল শুরু করেছে বলে জানায় বিআরটিসি। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, মোহাম্মদপুর–আজিমপুর রুটে বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরই চালু করা হবে।

ধানমন্ডি শংকর থেকে নিয়মিত নিউমার্কেট যাতায়াত করতেন আনিসুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসি বাস হওয়ায় চলাচলে বেশ স্বস্তি ছিল। বাসগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ বিপদে পড়েছি। লোকাল একটা বাস আছে কিন্তু ওটাতে গরমের মধ্যে অফিসে যাওয়া বেশ কষ্টকর। রিকশায় গেলে ভাড়া বেশি।’

একই রুটে অন্য বাসে লাভ

মোহাম্মদপুর থেকে আজিমপুর রুটে বিআরটিসি লোকসান দিলেও দীর্ঘ সময় ধরে চলা অল্প হলেও লাভ করেছে একটি লোকাল বাস সার্ভিস।

রাজধানীর এই রুটে দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিচ্ছে ১৩ নম্বর বাস। পরিবহন সেবাটির ১২টি বাস আছে। সেগুলোও বেশ পুরোনো ও পর্যাপ্ত ফ্যানের সুবিধাও নেই। পরিবহনটির বিকল্প হিসেবে এই রুটে আসে বিআরটিসি। বিআরটিসি যখন লোকসান গুনেছে, তখন ১৩ নম্বর বাসটি কিন্তু ঠিকই লাভ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৩ নম্বর বাসের এক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের আগে প্রতিটি বাস থেকে দিন শেষে ১ হাজার টাকার মতো লাভ থাকত।

বাসটির যাত্রীসংখ্যা গুনতে ও টাকা চুরি রোধে দুই বেলা/শিফটে কাজ করেন ১০ জন। তেল খরচ, চালক ও সহকারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে এই লাভ হয়েছে। প্রতিটি বাস দিনে ছয় থেকে সাতটি ট্রিপ দেয়।

কেন লোকসান

সম্প্রতি চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর জন্য সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বসে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। সেখানে লোকসানের বেশ কিছু কারণ দেখিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, সড়কে যানজট, রিকশার চলাচল বেশি, যাত্রীসংখ্যা কম ও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব অর্জিত না হওয়ায় সার্ভিসটি লোকসানের মুখে পড়ে এবং বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থেকে আজিমপুর রুটের সেবাটি সম্পর্কে বিআরটিসি বলেছে, এই রুটে রিকশা বেশি, যাত্রীসংখ্যা কম এবং প্রচণ্ড যানজট হওয়ায় নির্ধরিত কেপিএলের (কিলোমিটার পার লিটার) চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হয়।

ঢাকা শহরের মধ্যে এসি বাসে প্রতি লিটারে ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার যাওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছে বিআরটিসি। কিন্তু যানযটের কারণে জ্বালানি লাগে আরও বেশি। তেল খরচ বাদ দিলে টাকা থাকত এক হাজারের মতো। সেখান থেকে চালক ও সহকারীর বেতন দিয়ে আরও ঘাটতি থাকত বলে দাবি বিআরটিসির।

বিশেষ করে এসি বাসের বিষয়ে বিআরটিসি বলেছে, এসি বাসগুলো অনেক লম্বা, এমনকি দ্বিতল বাসের চেয়েও। যানযটে পড়লেও তেল খরচ বাঁচাতে এগুলোর ইঞ্জিন বন্ধ রাখা যায় না, যেহেতু এসি চালু রাখতে হয়।

সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ওই বৈঠকে বিআরটিসি আরও বলেছে, রাস্তায় রিকশা বেশি থাকায় গাড়ির গায়ে ঘষা লাগলে রং উঠে যায়, সৌন্দর্য নষ্ট হয়। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর থেকে আজিমপুর রুটে শিক্ষার্থী গাড়িতে উঠত বেশি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দিন যাত্রী কম হতো।

তবে এই রুটে অযান্ত্রিক যানসহ তিন চাকার যান ও লেগুনা চলাচল বন্ধ করলে এবং যানজট নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সার্ভিসটি চালু করা যাবে বলে উল্লেখ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ ছাড়া লোকসান কমাতে মোহাম্মদপুর–আজিমপুর রুটটি মতিঝিল পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব করেছে বিআরটিসি। এ ক্ষেত্রে এসি বাসের বদলে দ্বিতল বাস চালুর কথা ভাবছে তারা।

বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার (হিসাব) মো. আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটিসি সামাজিক সেবা দিচ্ছে বলে লোকসান হচ্ছে। লং রুটে (দীর্ঘ পথ) চললে তখন লাভ হয়। ছোট রুটে চললে যানজটের কারণেই খরচ বেড়ে যায়। তখন তেল খরচও ওঠে না। বিআরটিসির উদ্দেশ্য যাত্রীসেবা, রাষ্ট্রীয় নির্দেশে জনগণের উপকার করা।

তাঁর দাবি, অন্যান্য বাস দুপুরে খুব বেশি যাত্রী হয় না বলে সে সময়টায় খুব বেশি চলে না। কিন্তু বিআরটিসির বাস নির্দিষ্ট সময় পরপর ছাড়ে। এমনকি যাত্রী কম হলেও।