সময় শেষ, তারের জঞ্জাল থাকছে, বদলেছে সিদ্ধান্ত

  • ৪০ দিনে কাজ এগিয়েছে মাত্র একটি ওয়ার্ডে। দক্ষিণ সিটি এক মাস সময় বাড়িয়েছে।

  • সন্তুষ্ট নয় উত্তর সিটি, বৈঠক করবেন মেয়র।

  • অলিগলিতে ঝুলন্ত তার থাকছেই।

মাটির নিচের তার ব্যবহারে জটিলতা দুটি বিষয় নিয়ে—ফি বা মাশুল কত হবে এবং বাসাবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ কে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে ফি নিয়ে জটিলতার সুরাহা করতে পারেনি সরকার। ঝুলে ছিল বাসাবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ টেনে নেওয়ার বিষয়টিও। তাই ঢাকায় ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভির (ডিশ লাইন) তারের জঞ্জাল দূর হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তার মাটির নিচে নিতে যতই সময় বেঁধে দেওয়া হোক, সমস্যার কার্যকর সমাধান না করলে কাজ পুরোপুরি হবে না।

যেমন, ঢাকার সড়কের খুঁটি থেকে তারের জঞ্জাল সরিয়ে নিতে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময় দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এরপর ৪০ দিনে দক্ষিণের মাত্র একটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক কিছু কাজ হয়েছে। উত্তরেও পরিস্থিতি মোটামুটি একই। ডিএসসিসির বেঁধে দেওয়া সময় গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। অবশ্য সংস্থাটি আর তার কাটার অভিযানে যাচ্ছে না। বদলে ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভি সেবাদাতাদের (ডিশ লাইন) এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ সিটি এলাকার মূল সড়কের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের এক মাস সময় বাড়ানো হয়েছে
মো. আবু নাছের, দক্ষিণ সিটির মুখপাত্র

এদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এক সভার কার্যবিবরণী বলছে, পুরো ঢাকার তারের জঞ্জাল অপসারণে সেবাদাতারা এক বছর সময় পাচ্ছেন। আর ইন্টারনেট সেবাদাতারা বলছেন, ঢাকার অলিগলির তারের জঞ্জাল কোনো দিনই সরানো সম্ভব নয়।

সড়ক থেকে তা সরাতে ডিএসসিসি গত ৫ আগস্ট থেকে অভিযান শুরু করেছিল। এর প্রতিবাদে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) সেবা বন্ধের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর গত ১৮ অক্টোবর ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেন আইএসপিএবি ও কেব্‌ল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতারা। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন, নভেম্বর মাসের মধ্যে ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নেওয়া হবে। কিছু সড়কে কাজ করতে গিয়ে হয়তো বাড়তি সময় লাগতে পারে।

কাজ যেহেতু এগোয়নি, ডিএসসিসি এখন কী করবে—এ বিষয়ে মেয়রের বক্তব্য জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির মুখপাত্র মো. আবু নাছের প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটি এলাকার মূল সড়কের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের এক মাস সময় বাড়ানো হয়েছে।

এক মাস পরে কী তার কেটে দেওয়া হবে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা পরে সিদ্ধান্ত হবে।

মাটির নিচ দিয়ে ফাইবার অপটিক কেব্‌ল বসাতে বিটিআরসি ২০০৯ সালে প্রথমে ফাইবার অ্যাট হোম ও সামিট কমিউনিকেশনসকে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বা এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স দেয়। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিডেট (বিটিসিএল) ও বাহন লিমিটেড নামের চারটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। অবশ্য ঢাকায় প্রধান সড়কে মোটামুটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে শুধু সামিট ও ফাইবার অ্যাট হোম।

বড় সড়কে দুই এনটিটিএন অপারেটরের অপটিক্যাল ফাইবার বসানো থাকলেও বাসাবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ আছে মাত্র ৬০০০ পয়েন্টে। ঢাকায় ১০ লাখের বেশি ভবনের তুলনায় এটি খুবই সামান্য। আইএসপিগুলো যদি গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত সংযোগ দিতে পারে, তাহলে ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা নেই
এমদাদুল হক, আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক

নিয়ম অনুযায়ী, লাইসেন্স পাওয়া অপারেটর ছাড়া কেউ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে না। কিন্তু ঢাকায় বৈধ-অবৈধ ইন্টারনেট সেবাদাতা ও ডিশ ব্যবসায়ীরা মাটির ওপর দিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি ও সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির খুঁটি ব্যবহার করে তার ঝুলিয়ে ইন্টারনেট ও ডিশ সেবা দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনটিটিএন অপারেটর মাটির নিচে তার বসানোর পর তা ব্যবহারের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করেনি। খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ইন্টারনেট ও ডিশ সেবাদাতারা মাটির নিচের তার (অপটিক্যাল ফাইবার) ব্যবহারে আগ্রহ দেখাননি। ঢিলেমি ছিল সরকারেরও।

অলিগলি বাদে ঢাকার মোটামুটি সব এলাকায় তার মাটির নিচে নিতে ‘দুই বছরের মতো’ সময় লাগবে।

ঢাকায় আইএসপিগুলো গতির (এমবিপিএস) ভিন্নতা অনুযায়ী মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। অন্যদিকে ডিশ সংযোগ দেওয়া হয় মাসে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। তবে এসব আইএসপিকে মাটির নিচের অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করতে গেলে ফি দিতে হবে। সরকারকে কর দিতে হবে। এখন যে শত শত অবৈধ ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসায়ী রয়েছেন, তাঁদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বড় সড়কে দুই এনটিটিএন অপারেটরের অপটিক্যাল ফাইবার বসানো থাকলেও বাসাবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ আছে মাত্র ৬০০০ পয়েন্টে। ঢাকায় ১০ লাখের বেশি ভবনের তুলনায় এটি খুবই সামান্য। তিনি বলেন, আইএসপিগুলো যদি গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত সংযোগ দিতে পারে, তাহলে ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা নেই।

বিটিআরসির সভায় তিন সিদ্ধান্ত

তার সরানো নিয়ে গত ১১ নভেম্বর বিটিআরসিতে সব পক্ষকে নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। ১. যেসব এলাকায় গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ রয়েছে, সেখানে ঝুলন্ত তার নামিয়ে ফেলতে হবে। ২. যেসব এলাকায় গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত সংযোগ নেই, সেখানে লাইন বসাতে লিখিতভাবে এনটিটিএন অপারেটরকে জানাতে হবে। তারা ৭ দিনের মধ্যে আইএসপিকে জানাবে। এনটিটিএন অপারেটর না দিতে পারলে ইন্টারনেট সেবাদাতা তিন মাসের মধ্যে মাটির নিচ দিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার বসাবে। ৩. সমঝোতার মাধ্যমে এনটিটিএন অপারেটর ও আইএসপিএবি শুধু ঢাকা শহরের জন্য মাটির নিচের তার ব্যবহারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ফি নির্ধারণ করবে। সরকার নির্ধারণ করার আগ পর্যন্ত এটি বহাল থাকবে।

দুই এনটিটিএন অপারেটরের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মূল সমস্যা হলো, প্রতিটি ভবনে সংযোগ দিতে বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ উঠে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আমরা নীতিগতভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে চাই। সব পক্ষকে নিয়ে কাজটি করতে গেলে সেটা সহজ হয় না। এবার আশা করি কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারব। তবে বিটিআরসিতে অবসরজনিত কারণে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি পদে পরিবর্তন হবে। এ কারণে কিছুদিন সময় লাগতে পারে
মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী

মাটির নিচের তার ব্যবহার নিশ্চিতে করণীয় কী—জানতে চাইলে সামিট কমিউনিকেশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফ আল ইসলাম তিনটি বিষয় বলেন। বাড়ি বাড়ি সংযোগ মাটির নিচ থেকে নেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা, সেবাদাতারা ঝুলন্ত তার ব্যবহার করবেন না, সেটা নিশ্চিত এবং ফি নির্ধারণ করে জটিলতা দূর করতে হবে।

আরিফ আল ইসলাম আরও বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, আমরা ছয়টি বিভাগীয় শহরেই বিনিয়োগ করতে চাই। মূল সড়ক ও উপসড়কে তার বসাতে চাই। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু বিনিয়োগের পর তার ব্যবহার হবে, সেই নিশ্চয়তা না থাকলে কেউ বিনিয়োগ করবে না।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাটির নিচের তার ব্যবহারের ফি নিয়ে তিন বছর ধরে নানা কথা হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বিটিআরসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে ফি পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ পরে ভেস্তে যায়। এখন ফি নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তারা এ বিষয়ে একটি কমিটি করেছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে চাই। সব পক্ষকে নিয়ে কাজটি করতে গেলে সেটা সহজ হয় না।’ তিনি বলেন, ‘এবার আশা করি কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারব। তবে বিটিআরসিতে অবসরজনিত কারণে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি পদে পরিবর্তন হবে। এ কারণে কিছুদিন সময় লাগতে পারে।’

কাজের গতি আরও বাড়াতে হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন
মো. আতিকুল ইসলাম , ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র

৪০ দিনে কী হলো

ডিএসসিসি এলাকার মধ্যে শুধু ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড-সংলগ্ন আশপাশের এলাকায় মাটির নিচে তার স্থানান্তরের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে আইএসপিএবি। অন্যদিকে উত্তরে গুলশান অ্যাভিনিউ ও উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের তিনটি সড়কে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে উত্তরা ৪, ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন সড়কে এবং গুলশানের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এলাকা থেকে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে কাজ চলছে।

আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত সংযোগ বসানোর কাজটি তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে করছেন। তবে এ নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করতে চান। তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় অলিগলির ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য যে বিনিয়োগ লাগবে, তা উঠিয়ে আনা কঠিন।

এমদাদুল হক আরও বলেন, তাঁরা মোটামুটি বড় সড়কগুলোতে তার মাটির নিচে নেওয়া নিয়ে কাজ করছেন। সরকারের সহযোগিতা পেলে এবং রাস্তা কাটার ফি মওকুফ হলে পুরো ঢাকায় কাজটি করতে দুই বছরের মতো সময় লাগবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সরাসরি তার কাটার অভিযানে না নেমে আইএসপিএবিকে মাটির নিচে তার স্থানান্তরের সুযোগ দিয়েছিল। তবে তাদের এই কাজে সন্তুষ্ট নয় সংস্থাটি। উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাজের গতি আরও বাড়াতে হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যে গতিতে তার মাটির নিচে স্থানান্তরের কাজ করছে, এই গতিতে পুরো ঢাকায় কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলা আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালের ৭ জুলাই বিটিআরসি টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ভাগাভাগি করার একটি নীতিমালা করে। এতে এনটিটিএন অপারেটর ছাড়া অন্যদের অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, মোবাইল অপারেটর, আইএসপিসহ অন্যরা যদি অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর সুযোগ পেত এবং সেটা ভাগাভাগিতে বাধ্য থাকত, তাহলে উন্নত নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত।