সাধারণের আনন্দময় পাঠাগার

৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার। এ উপলক্ষে সদস্যরা নিয়মিত পাঠাগারে আসছেন। গত বুধবার
ছবি: প্রথম আলো

পাঠাগারটিতে আছে ১৬ হাজার বই। বড়সড় একটি কক্ষে কয়েকটি কাঠের তাকে বন্দী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’

অবস্থান রাজধানীর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠা খিলগাঁও এলাকায়। নাম শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার। আজ ২২ জানুয়ারি পাঠাগারটির ৫০ বছর পূর্ণ হলো। ‘সমাজে আসুক সমতা-সাম্য, বোধসম্পন্ন মানুষই কাম্য’ স্লোগানে শুরু হয়েছে বাকী স্মৃতি পাঠাগারের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন। চলবে দুই সপ্তাহব্যাপী।

আমরা ফিরে যাই সেই দিনগুলোতে, জেনে নিই সেই সময়ে কিছু উদ্যমী মানুষের প্রচেষ্টার কথা।

১৯৬৭ সাল, ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন চলছে। চারদিকে অস্থিরতা। এমন সময় হাফিজুর রহমানের (ময়না) নেতৃত্বে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার ১১ জন তরুণ গড়ে তুললেন সামাজিক সংগঠন পল্লীমা সংসদ। মূলত খেলাধুলাকে ঘিরেই এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু।

কিন্তু সবারই বই পড়ার আগ্রহ। হাফিজুর বই কিনে সবাইকে দেন পড়ার জন্য। আনু মুহাম্মদ (অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, হাফিজুর রহমানের ছোট ভাই) অঙ্কুর নামে পাঠাগার গড়ে তুললেন বর্তমান পল্লীমা সংসদের পাশে এক বাড়িতে। কারণ, পল্লীমার তখন অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। পল্লীমার সাংগঠনিক সম্পাদক তখন আবদুল্লাহ হীল বাকী নামে এক টগবগে তরুণ। ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। জন্ম মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে, ১৯৫০ সালের ১৯ জুন। পাকিস্তানি হানাদারদের নিষ্ঠুরতা দেখে বসে থাকতে পারেননি ২০ বছরের বাকী। গঠিত হলো ৪৫ জনের দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। ইউনিটের কমান্ডার হলেন স্বয়ং বাকী। আবদুল্লাহ হীল বাকী ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় শহীদ হলেন। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার তাঁকে দেয় বীর প্রতীক খেতাব।

স্বাধীনতার পরপরই আবার শুরু হয় পল্লীমা সংসদের কাজ। সবাই সিদ্ধান্ত নেন একটা পাঠাগার স্থাপনের। নাম ঠিক হয় শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরু হয় পল্লীমা সংসদের প্রথম অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাকী স্মৃতি পাঠাগারের যাত্রা।

যাত্রা শুরু হলো, কিন্তু কাঠামো কোথায়? বিভিন্নজনকে ধরে শুরু হলো একটা ভবন তৈরির কাজ। ভবনের দরজা–জানালার জন্য কাঠ লাগবে। হাফিজুর রহমান এসে বললেন, তাঁর নানার বাড়িতে একটা গাছ বিক্রি হবে। অনেক বড়।

সবাই মিলে জামালপুরের গোপীনাথপুর গিয়ে সেই গাছ কিনে এনে তৈরি হলো পাঠাগারের দরজা–জানালা। যার যার সংগ্রহে থাকা বই নিয়ে এলেন। ’৭৬–পরবর্তী সময়ে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ল পাঠাগারের কার্যক্রম। জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত সবাই। কেউ চাকরি বা পড়াশোনায়। কিন্তু স্বপ্ন রয়ে গেল একটা আধুনিক পাঠাগারের।

১৯৮৮–এর দিকে নতুন প্রজন্ম উদ্যোগ নিয়ে পাঠাগারের কাজ শুরু করল। তত দিনে পল্লীমা সংসদও আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠেছে। পল্লীমার সদস্য ফজল মাহমুদ তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো বড় পরিসরে পাঠাগারটি গড়ে তোলার। ১৯৮৮ সালের দিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আসাদুর রহমানকে (নাসিম) আহ্বায়ক করে কমিটি গঠিত হলো। সম্প্রসারিত নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হলো বাকী স্মৃতি পাঠাগার। ১৯৯১ সালে উদ্বোধন করলেন তৎকালীন সংসদ উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

পল্লীমার সাংগঠনিক কাঠামোর নিয়ম অনুসারে প্রতি দুই বছরের জন্য পাঠাগার পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়, যেখানে পাঠাগারের চেয়ারম্যান ও সম্পাদক পদ রয়েছে। সবার প্রচেষ্টা থাকে আগের ধারাবাহিকতায় নতুন কিছু যুক্ত করা। ২০১৩ সালে আরও বড় পরিসরে পাঠাগারটি নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। তৎকালীন চেয়ারম্যান লুতফর রহমান আর সম্পাদক কাজী খোশনুর নিমুর প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা হয় ১২টি কম্পিউটার নিয়ে বই ক্যাফে বা ই বুক কর্নার।

২০১৫ সাল থেকে পল্লীমা সংসদে প্রতিবছর বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে, যেখানে দেশের প্রায় সব বড় প্রকাশনী অংশ নেয়।

তিন হাজার বর্গফুটের পাঠাগারে প্রতিবছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। কেনা হচ্ছে নতুন নতুন বই। নিবন্ধিত পাঠকের সংখ্যা ছয় শতাধিক। পাঠাগারের চেয়ারম্যান হিসেবে এখন আছেন জুলফিকার হোসেন আর সম্পাদক আনিসুল হোসেন (তারেক)।

পাঠাগারে শিশু–কিশোরদের জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার। প্রতি শনিবার পাঠাগার শুধু শিশু–কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। পাঠচক্র, গল্প পাঠ, গানের আয়োজন, কবিতা পাঠ হয়। এখানকার ছেলেমেয়েরা সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। শিগগিরই বিজ্ঞান কর্নার করা হবে, যেখানে বিজ্ঞানবিষয়ক বই থাকবে, আলোচনা হবে। পাঠাগার সম্পাদক আনিসুল হোসেন বললেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য হলো একদম সাধারণ মানুষের জন্য একটি আনন্দময় পাঠাগার করা।

নিবন্ধন খাতা খুলে দেখা গেল, কেবল খিলগাঁও নয়, আশপাশের এলাকা মালিবাগ, শান্তিবাগ, গুলবাগ, সবুজবাগ, মিরবাগ, রামপুরা, গোড়ান, মুগদা এলাকার পাঠক কম নয়।

পুরোনো ও নামী পাঠাগার বলে এর অনেক সুহৃদ ছড়িয়ে আছেন দেশে-বিদেশে। কেউ কেউ আছেন বিদেশ থেকে ফেরার সময় পাঠাগারের জন্য উপহারস্বরূপ মূল্যবান বই নিয়ে আসেন।

পাঠাগারে বর্তমানে পাঠক কম, সেটা একটা বাস্তবতা, করোনাকালে যা আরও বেশি।
৬৮ বছর বয়সেও পল্লীমাসহ পাঠাগারের প্রতিটি কাজে সক্রিয় হাফিজুর রহমান। তাঁর কথা, ‘নানা ধরনের প্রযুক্তির অভিঘাত পাঠাগারে পাঠক না পাওয়ার একটা কারণ বটে, তবে পাঠকের জন্য লড়াই সবকালেই করতে হয়েছে। ইতিহাস এমনই বলে। এখন আমরা ঢাকার পাঠাগারগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনের মধ্য দিয়ে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছি।’

প্রতিষ্ঠাকালেই একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখেছিল বাকী স্মৃতি পাঠাগার, যেখানে বই নিয়ে পাঠকের দুয়ারে হাজির হবে পাঠাগারের গাড়ি। পূরণ না হলেও সেই স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে।

৫০ বছর একটি পাঠাগারের সফলভাবে টিকে থাকা দেশে গণপাঠাগার আন্দোলনের বড় বিজ্ঞাপন। একই সঙ্গে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকা পাঠাগারগুলোর জন্য উদাহরণও।